আলমগীর খান

  ২৮ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সম্ভাবনা

বর্তমান বিশ্ব নানারূপ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বৈষম্য তার মধ্যে অন্যতম। প্রায় প্রত্যেক দেশের মধ্যেই সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই গতি অব্যাহত আছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য আবার বহু সংকটের জন্মদাতা। আর বৈষম্যের জন্মদাতা কে? উত্তর : বৃহৎ উৎপাদনের উপায়গুলোর ব্যক্তিমালিকানা। পুঁজিবাদের মূল রূপ ব্যক্তিমালিকানা হলেও, সেটি একই অবস্থায় বসে নেই। যৌথ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক পুঁজিবাদও আছে। তবে মূল রূপ ব্যক্তিমালিকানা। মূলে একই থেকেও পুঁজিবাদ এ পর্যন্ত চারটি শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয়টি ঘটে বিদ্যুৎ ও পণ্যের বহুল উৎপাদনের মধ্য দিয়ে, তৃতীয়টি ছিল কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আবিষ্কার ও ব্যবহার, আর বর্তমানটি হচ্ছে রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার।

বিজ্ঞানের সহায়তায় এই প্রতিটি বিরাট আবিষ্কার ও পরিবর্তনই মানুষের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতিটি পরিবর্তন মানুষের জন্য নিরঙ্কুশ সুখের হয়নি। বরং অনেক দুঃখ-দুর্দশাও তাকে গ্রাস করেছে। একেকটি শিল্পবিপ্লবের পর বহু মানুষ বেকার ও উন্মূল হয়েছে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, যদিও সামগ্রিকভাবে মানুষ উপকৃত হয়েছে। বর্তমানে যে বিপ্লবের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে তাতে আরো অনেক বেশি ঝুঁকি আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের পারিবারিক, নৈতিক ও সামাজিক প্রভাব অকল্পনীয় হতে পারে। বেকারত্ব, উন্মূল হওয়া, মজুরি হ্রাস ইত্যাদি সমস্যা তো থাকছেই। আবার যে ব্যক্তি কোনো বিশেষ দক্ষতার উঁচু ধাপে আছে তার আয় হবে তার নিকটবর্তীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি, যা বৈষম্যকে চরম রূপ দেবে। বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকরা এসব নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। গার্ডিয়ান পত্রিকায় হিদার স্টুয়ার্ট লিখেছিলেন, ‘রোবট বিপ্লব বাণিজ্যের ব্যয় কমিয়ে এনে ও সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পাল্টে দেবে।’ (রোবট বিপ্লব : ‘চিন্তাশীল’ যন্ত্রের উদ্ভব বৈষম্যকে তীব্র করতে পারে, ৫ নভেম্বর ২০১৫)। গার্ডিয়ান পত্রিকার অর্থনীতি সম্পাদক ল্যারি এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘সত্যি, এ পর্যন্ত পাওয়া সব সাক্ষ্য বলছে, আসন্ন পরিবর্তনের সুফল গুটিকয় অভিজাত ব্যক্তির কুক্ষিগত হবে, যা বর্তমান বৈষম্যের ধারাকে আরো গভীর করে তুলবে।’ (চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানবতার জন্য সম্ভাবনা ও বিপদ ডেকে আনছে, দ্য গার্ডিয়ান, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬)। ক্লাউস শোয়ব লিখেছেন, ‘আজ পৃথিবী যে হাজারটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শতাব্দীর শেষে শিল্পবিপ্লব কী রূপ নেবে তাই। নতুন প্রযুক্তি ও উপায় পদার্থিক, ডিজিটাল ও জৈবিক বিশ্বের এমন মিশ্রণ ঘটাবে যে তা মানবজাতিকে মৌলিকভাবে বদলে দেবে। এ পরিবর্তন কতটা কল্যাণকর হবে তা নির্ভর করছে আমরা কীভাবে এ সমস্যা ও সম্ভাবনার সলিল পাড়ি দিচ্ছি তার ওপর।’ (চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কাজে লাগানো, প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট, ১১ জানুয়ারি ২০১৬)।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ছিল ২০১৬ সালে ডাভোসে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মূল বিষয়। বর্তমানে এটি এমন তড়িৎ গতিতে এগিয়ে চলেছে যে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা তাল মেলাতে পারছেন না। এর ভালো-মন্দ দিক সবাই ওজন করে দেখছেন এবং আতঙ্কিত হচ্ছেন। কেননা এবারকার পরিবর্তন অন্য তিনটি পরিবর্তনের চেয়েও বড় মাপের। কেউ কেউ এ গতির রাশ টেনে ধরাই নিরাপদ মনে করছেন। এ আতঙ্কের মূল কারণ কী? নিঃসন্দেহে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ব্যাপক সম্পদ তৈরি করবে। কিন্তু এই রোবট ও বড় আকারের ‘চিন্তাশীল’ যন্ত্রপাতির মালিক হবে গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাই উৎপাদিত সম্পদেরও বেশির ভাগ অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে যাবে আর বঞ্চিত হবে লাখ লাখ মানুষ। তার মানে এই বিপ্লব সার্বিক মানুষের কল্যাণ না করে বহু মানুষের জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলবে। এর কারণ এই শিল্পবিপ্লবের ফসলকে সঠিকভাবে ব্যবহারের ক্ষমতা বর্তমান মানুষের নেই। ব্যক্তিমালিকানার একাধিপত্য এ সুফলকে মানবজাতির জন্য দুঃখে পরিণত করতে যাচ্ছে। কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়। মানবজাতির এই বিরাট আবিষ্কার মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এক স্বর্ণযুগে পৌঁছে দেওয়ার কথা। অথচ সম্পদের মালিকানা ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে তা হচ্ছে না। যে সুবিধা সব মানুষের প্রাপ্য তা গুটিকয় মানুষের কুক্ষিগত হচ্ছেÑ এটিই মূল সংকট।

বহু মানুষ বেকার হবে কারণ যন্ত্র কাজ করার ফলে তাদের কাজ করার দরকার হবে না। তাই বলে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে কেন বা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে না কেন? যখন কিনা সম্পদ পৃথিবীতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কল্পনাতীত আকারে বেশি উৎপন্ন হবে। এমনকি এত বেশি উৎপাদিত হতে পারে যে প্রত্যেকর চাহিদা পূরণ হয়েও সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। তাই বলে যে মানুষ বসে বসে অলস সময় কাটাবে তা তো নয়। তখন মানুষের সময় ব্যয় হবে সব মানুষের জন্য কল্যাণকর সৃষ্টিশীল কর্মকা-ে। যন্ত্র মানুষকে কাজের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে অফুরন্ত সময় দেবে সৃষ্টিশীল কাজের জন্য। আর তা সম্ভব না হওয়ার একমাত্র কারণ উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর গুটিকয় ব্যক্তির একচ্ছত্র মালিকানা ও আধিপত্য। ল্যারি এলিয়ট লিখেছেন, ‘সেই ১৯৩০ সালে কেইনস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মানুষের সাপ্তাহিক কর্মসময় কমে হয়তো সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টায় নামবে যখন মানুষ তার চাহিদা পূরণ করে অনেক বেশি অবসর উপভোগের সুযোগ পাবে। পৃথিবী তখন মন্দায় আক্রান্ত, কিন্তু কেইনস নিশ্চিত ছিলেন, দীর্ঘকাল সাপেক্ষে মানবজাতি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। কেইনস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একশো বছরের মধ্যে প্রগতিশীল দেশে মানুষের জীবনযাত্রার মান চার থেকে আট গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষ জীবনের সুন্দর দিকগুরো উপভোগের জন্য বেশি সময় পাবে।’ (অর্থশাস্ত্র : কেইনসের ১৫ ঘণ্টা সাপ্তাহিক কর্মসময়ের কী হলো? দ্য গার্ডিয়ান, ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮)। ১৫-ঘণ্টা সাপ্তাহিক কর্মসময় পাওয়া না গেলেও, উন্নত দেশে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কেইনসীয় ভবিষ্যদ্বাণী কিন্তু ফলেছে। ১৫ ঘণ্টা সাপ্তাহিক কর্মসময় বাস্তবায়িত না হওয়ার যে কারণ এলিয়ট সাহেব পেয়েছেন তা হলো : বণ্টনের যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনে কেইনসের ব্যর্থতা। কেবল ১৫ ঘণ্টা সাপ্তাহিক কর্মসময় নয়, যদি যান্ত্রিক উন্নতির ফলে আরো সহজে আরো বেশি সম্পদও উৎপাদন করা সম্ভব হয়, তবু মানুষের মজুরি-দাসত্বে পরিবর্তন হবে না, তবু বিরাটসংখ্যক মানুষকে গাধার খাটুনিই খেটে যেতে হবে যদি পৃথিবীতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা না যায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আজ যে বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে তাও দুঃখ-দুর্দশার উৎস হবে যদি সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন বজায় থাকে। এ শিল্পবিপ্লব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে তাই এত ভয়। হয় পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের পরামর্শমতো বৈশ্বিক করারোপের মাধ্যমে অথবা বৈপ্লবিক উপায়ে সম্পদের সামাজিক মালিকানা তৈরির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হতে হবে। তবেই কেবল চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জন্য কোনো দুঃখের নয়, সুখের উৎস হয়ে উঠতে পারে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist