ডা. এস এ মালেক

  ২৬ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

স্বাধীনতার মহানায়ক

বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসের ৭, ১৭ ও ২৬ তারিখে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৭ মার্চের কারণে ৭ মার্চ এবং ২৬ মার্চ সম্ভব হয়েছে। ১৭ মার্চ বাংলাদেশের নিভৃত এক পল্লী টুঙ্গিপাড়ায় যদি সেই রাখাল বালকের জন্ম না হতো, তাহলে ৭ ও ২৬ মার্চের ঘটনা কে ঘটাত? বটের ক্ষুদ্র বীজ থেকে চারাগাছ হিসেবে জন্ম নিয়ে বটগাছে মহীরুহে আকার ধারণ করে। সে দিনের সেই রাখাল বালক ক্রমাগত অগ্রগতির পথে চলতে চলতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিতে রূপান্তরিত হন। এখন স্পষ্ট করেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজকের বাংলাদেশই ছিল পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালির ভোটেই পাকিস্তানের জন্ম। আর সেই পাকিস্তানেই বাঙালিরা ছিল নিপীড়িত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত। ওরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল উর্দুকে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়েই ১৯৪৮ সালে ওই ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিবাদমুখর হয় বাঙালির দামাল ছেলেরা। নো, নো বলে গর্জে ওঠে তারা। সেদিনের সেই নো, নো যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, তিনি হচ্ছেন প্রলয়ঙ্করী যুবক মুজিব ভাই। তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। জাতির পিতা হওয়ার ব্যাপারটা ছিল স্বপ্নস্বরূপ। আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির কথা তো চিন্তাই করা যেত না। রাখাল রাজার অসাধারণ ঘটনাবহুল জীবনের মূল কারণ ছিল তাঁর আমৃত্যু দেশপ্রেম, সাহসিকতা, সততা ও সাধারণ মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের আধা ঔপনিবেশিক বাংলাদেশকে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে যে চরম বিপর্যয়ে নিপতিত করেছিল, তা উপলব্ধি করে শেখ মুজিবের হৃদয় কেঁদে ওঠে। মুক্তির বৈপ্লবিক চিন্তায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। কী করে দেশের মানুষকে স্বাধীন, শোষণমুক্ত ও সমৃদ্ধিশালী করা যায়, এটাই ছিল তার জীবনের স্বপ্ন-সাধনা। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি। বিশ্ব মানবতা তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন একটি শোষক ও অন্যটি শোষিত। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি শোষিতের পক্ষে। আর ওই শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যেই অবশেষে তাঁর জীবন দিতে হয়।

অনেকে বলেন, তিনি একদলীয় শাসন করে গণতন্ত্র হত্যা করেছেন। ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন ও ৭৩-এর সেই সংবিধানভিত্তিক নির্বাচন। সেই নির্বাচন ও সেই জাতীয় নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়ে তিনিই প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় তিন বছর সেই গণতন্ত্র কার্যকর ছিল এবং সেই গণতন্ত্রের সুবাদে স্বাধীনতার শত্রুরা এমন এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তাঁকে সাময়িকভাবে গণতন্ত্র সীমিত করে একটা জাতীয় দল গঠন করে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির সর্বাত্মক শক্তি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন এবং সে কারণে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অর্থে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় পরিবর্তন করতে হয়েছিল, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে ছিল বেশ কিছুটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ওটা ছিল একটা সাময়িক ব্যবস্থাপনা। তিনি বলেছিলেন, বাস্তব অবস্থা স্বাভাবিক হলেই তিনি পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে নেবেন। ওই কর্মসূচিকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব বলে অভিহিত করেছিলেন এবং ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগেই স্বাধীনতার শত্রুরা আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীর চক্রান্তের সহযোগিতায় তাঁকে স্বগৃহে প্রায় সব পারিবারিক সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করল। এরপর শুরু হলো উল্টোপথের যাত্রা। জিয়া, এরশাদ, খালেদা, সায়েম ও সাত্তার সুদীর্ঘ ১৫ বছর একটানা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের পরামর্শে রাজকার, আলবদর ও আল-শামসদের সরকার ও রাজনীতিতে অংশীদারিত্ব দিয়ে প্রায় পাকিস্তানের কাছাকাছি রূপে একটা রাষ্ট্রে রূপান্তর করল। যাকে তারা মুসলিম বাংলা বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রতিবিপ্লবী চক্র ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে স্বৈরাচারকবলিত করে ঠিক পাকিস্তানি কায়দার প্রক্রিয়া ধারায় এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালান। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অনুরূপ একটা সাম্প্রদায়িক প্রগতিবিরোধী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করলেন। ঠিক এমনি সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থেকে বিশেষ কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং তার বাবার স্বাধীন করা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

মাত্র তিন বছরে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান যা পাকিস্তানের একটা প্রদেশ ছিল ও সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না। বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তর করার লক্ষ্যে তিনি সব অবকাঠামো তৈরির প্রস্তাব দিলেন। বর্তমান শাসকরা নতুন করে সেখানেই হাত দিচ্ছেন, বিশেষ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার অভিমত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে বঙ্গবন্ধু সূচনা করেননি। একটা প্রাদেশিক সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তর করা সহজসাধ্য ছিল না। ব্যাংকে টাকা ছিল না, গুদামে শস্য ছিল না, বাজারে নিত্যব্যবহারযোগ্য পণ্যও ছিল না। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, শিল্প-কারখানা, হাটবাজার, কৃষিকার্য এমনকি যানবাহন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর ছিল। এক কোটি মানুষ অনাহারে শরণার্থী দেশে ফিরে আসছিল আর দেশের অভ্যন্তরে ছিল আরো দুই কোটি মানুষ। তাদের প্রায় এক বছর খাদ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল। বসবাস করার মতো কোনো আশ্রয়ও ছিল না। লাখ লাখ পরিবারকে আশ্রয় স্থান নির্মাণ করে দিতে হয়েছিল। কৃষিব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রত্যেকটি পরিবারকে বেশ কয়েক হাজার টাকা অনুদান ও ঋণ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকটা যুদ্ধে নিহত মানুষদের কমপক্ষে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাড়ে তিন বছর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হলেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৩ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে।

৫২-৭১ এই ১৯ বছরই বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। একটা দিনের জন্যও তাঁকে হানাদার পাকিস্তানিরা স্বস্তি দেয়নি। ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করেছেন এ দেশের মানুষের জন্য। বারবার ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার আপস করেননি। নিজের জীবনের চেয়েও তিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখতেন ও তাদের জন্য চরম আত্মত্যাগে প্রস্তুত ছিলেন। এ দেশের মানুষের রক্তের ঋণ শোধ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন। এ কারণেই আজ বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে জনগণের মূল্যায়ন হচ্ছে : তিনিই স্বাধীনতা, তাঁর নামের অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে একমাত্র তাঁকেই বোঝায়। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যারা বাংলাদেশকে না চিনলেও বঙ্গবন্ধুকে চিনে ও তাঁর স্বাধীন করা দেশ চিনে। তিনি শুধু বাঙালির নেতা নন, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। জয় বাংলা বলতে তিনি শুধু বাঙালির বিজয়কে বোঝাননি, পৃথিবীর যেকোনো দেশের সাধারণ মানুষের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে তিনি জয় বাংলা বলেছেন। সব শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর তিনি। সব কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সর্বাত্মক মুক্তির কথাই তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর বজ্রকণ্ঠে যে জয় বাংলা বাণী নিঃসৃত হয়েছিল, এর ওপর ভর করেই আমরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাতিসত্তায় রূপান্তর করে জাতি রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই। তাই তো তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর বিকল্প কেউ বর্তমান নেই, আগামীতেও হবে না। তিনি একজন চিরঞ্জীব, বাংলার মানুষের মুক্তিদাতা।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist