জি. কে. সাদিক

  ২৫ মার্চ, ২০১৮

বিশ্লেষণ

স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও উন্নয়নশীল দেশের (এলইডিসি) স্বীকৃতি আমাদের জন্য বড় ধরনের একটা অর্জন। তবে বিশেষ কিছু কারণে ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ এই স্বীকৃতিটা আমাদের অর্থনীতিকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। এ ঝুঁকি মোকাবিলা করা আমাদের অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য চ্যালেঞ্জ। যেসব দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ পেয়েছে, তার মধ্যে খনিজ সম্পদনির্ভর দেশ রয়েছে এবং পর্যটননির্ভর দ্বীপ রাষ্ট্র রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। তাই বাংলাদেশের জন্য নিম্নের ঝুঁকিগুলো মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

১. বেসরকারি বিনিয়োগে ক্রমবর্ধমান অবনতি, ২. বেকার সমস্যা বৃদ্ধি এবং ৩. অনুদান ও স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তি কমে যাওয়া। উপরযুক্ত প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগে হার কমছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে নেমে আসে। গত পাঁচ বছরে তা আরো কমে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে আসে ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশে। আজ পর্যন্ত এ ভাটা থামছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুঁজি সহজলভ্যতা সমস্যা, অবকাঠামো উন্নয়ন সমস্যা, সুশাসনের অভাব, কাঁচামালের ঘাটতি-এসব কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ খাত অনেকটা ভাটার সম্মুখীন। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জিডিপির ২৪ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন। অর্থাৎ চলতি বছরে বেসরকারি খাতে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রদত্ত তথ্যমতে, এ বছর বেসরকারি খাতে প্রথম ৬ মাসে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের এ সময়ও ছিল ৭৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য মতেও বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে প্রবৃদ্ধি না বাড়ার কথা বলা হয়েছ। তাই বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে চলমান ভাটা ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ স্বল্পোন্নত দেশের বিনিয়োগ আর উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগ সুবিধায় অনেক তারতম্য আছে। স্বল্পোন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশে করের পরিমাণ বাড়ে যেটা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টিতে বাধার কারণ হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। এর অন্যতম হলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাঁচামালের জোগান সমস্যা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা ও শ্রম আইনের বাস্তবায়ন না থাকায় শ্রমিক আন্দোলনের সমস্যা। বর্তমানে আমাদের রফতানি শিল্পের প্রধান হলো গার্মেন্টশিল্প কিন্তু এ শিল্প সম্প্রতি সময়ে কাঁধে নানা প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকির পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে।

২. দ্বিতীয় যে বিষয় সেটা হলো বেকার সমস্যা। এটা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী সাড়ে চার কোটি কর্মক্ষম মানুষ স্বীকৃত শ্রমশক্তির বাইরে আছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নারী। আর বাকি ১ কোটি ২০ লাখ তরুণ যারা পড়ালেখাও করছে না, আবার শ্রম বা প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াতেও নেই। প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, দেশে ছদ্মবেকারের সংখ্যা ৬৬ লাখ। তাদের মধ্যে চাকরি খুঁজেও পায়নি এমন বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। ১৪ লাখ মানুষ খ-কালীন চাকরি করছে। যাদের চাকরির কোনো ধরনের নিশ্চয়তা নেই। ২৪ লাখ মানুষ কখনো চাকরি খুঁজেনি; কিন্তু তারা চাকরির যোগ্য। দেশের বেকার সংখ্যার এ ক্রমবর্ধমান চিত্র ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ স্বীকৃতির পর আমাদের অর্থনীতির জন্য দ্বিতীয় গলার কাঁটা। বেকার সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনাও খুবই ক্ষিণ। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরিমাণে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজন সেটা আশানুরূপ হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমছে; ২০১৬ সালে কৃষি খাতে নিয়োজিত ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ, এ বছর তা কমেছে ৭ লাখ। এর কারণ হলো প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, এ খাতে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। অন্যদিকে বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি থমকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোয় অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য

আগের মতো শ্রমশক্তি রফতানি হচ্ছে না। তাই প্রবাসী আয়ের পরিমাণও কমছে, যাও রফতানি হচ্ছে তা জনসংখ্যা

রফতানি হচ্ছে জনশক্তি নয়। তাই কাক্সিক্ষত আয় হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশের ভেতরেও উদ্যোগতা নেই। আর উদ্যোগতা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ প্রণোদনা প্রয়োজন, তা খুবই অপ্রতুল। তাই বেকার সমস্যার সমাধান একটা বড় ধরনের ‘ফ্যাক্ট’।

৩. উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। এক. মাথাপিছু আয়, দুই. মানবসম্পদ সূচক এবং তিন. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। বাংলাদেশ এই তিনটি ক্ষেত্রেই বেশ সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু কথা হলো যখন একটি দেশে এলডিসি থেকে উত্তরণ পায়, তখন বৈদেশিক অনুদান ও স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তি কমে যায়। সে সময় বেশি সুদে ঋণ সুবিধা নিতে হয়। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে বাংলাদেশও ওই অনুদান ও ঋণ সুবিধা আর পাবে না। যেটা আগে পাওয়া যেত। তাই নতুন একটা ঝুঁকি আমাদের সামনে আসছে। নি¤œ আয়ের দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) মাধ্যমে বিনামূল্যে ঋণ দিয়ে থাকে বিশ্বব্যাংক। যার সার্ভিস চার্জ মাত্র দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৮ বছর রেয়াতকলাসহ ৩৮ বছরে এ ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২১৫ ডলার হলে এ ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশ এখন আর এ সুবিধা পাবে না। সে ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সুবিধায় ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রি-কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেপলমেন্ট (আইবিআরডি) তহবিল থেকে ঋণ নিতে হয়। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে বৈদেশিক অনুদান ও স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা ছিল তা আর থাকছে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগী হতে হবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।

৪. বেসরকারি বিনিয়োগে ঘাটতি, বেকার সমস্যা, কর্মসংস্থান তুলনামূলক কম বৃদ্ধি হওয়া, বৈদেশিক অনুদান ও স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা না থাকা আমাদের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়াও মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, শহরের সঙ্গে ও গ্রামের আয়বৈষম্যও চরমে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রয়েছে প্রতিবন্ধকতা, আঠার মতো লেগে আছে দূর্নীতি, অর্থপাচার ক্রমবর্ধমান। নাগরিক সেবাগুলোও নিশ্চিত করতে সরকার পুরোপুরি সফল নয়। নগর বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা এখনো বাস্তবায়নে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে সরকার অনেকটা উদাসীনও বটে। নারী-পুরুষের আয়বৈষম্যও অনেক। বিবিএসের তথ্যমতে দেশের ৬৭ শতাংশ নারীর কাজই উপেক্ষিত। অথচ বর্তমানে দেশে নারী-পুরুষের অনুপাত যথাক্রমে ৫১:৪৯। নারীরা শ্রম দিচ্ছে কিন্তু তা আমাদের জিডিপিতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার হলেও সব নাগরিকের আয় এক নয়। এটা গড় হিসেবে মাত্র। তাই এ বিষয়গুলো আমাদের অর্থনীতিকে আগামী দিনে প্রভাবিত করবে। অন্যদিকে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিলেও চূড়ান্তে পৌঁছাতে এখনো তিন ধাপ বাকি আছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে থাকবে আমাদের অর্থনীতির গতিবিধি। বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর আদায় বাড়ানো, বৈষম্য দূর ও দারিদ্র্যবিমোচন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দক্ষতার উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশে’র স্বীকৃতি হয়তো কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist