রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্লেষণ
পানির ন্যায্য অধিকার ও কিছু কথা
আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মনমোহন সিং তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময় মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসেননি। ফলে মনমোহন সিংয়ের শত ইচ্ছা থাকার পরও বিশেষ করে তিস্তার পানি চুক্তি আটকে যায়। দেখতে দেখতে আটটি বছর অতিবাহিত হলো। কিন্তু দিদি মমতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির আশ্বাস অব্যাহত রাখলেও কার্যত তাও নিশ্চিত হচ্ছে না। সাফ কথা, দিদি মমতার পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ উপেক্ষা করে তিস্তা চুক্তি সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার অভাবে বাংলাদেশের নদ-নদী, জীববৈচিত্র্য, চাষাবাদ সবই আজ হুমকির মুখে। তবু কেন মমতা ব্যানার্জির মন গলে না, যা আমাদের বোধগম্যের অনেক বাইরে। ছোট্ট ভূখ-ের বাংলাদেশের জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। যাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হলে খাদ্যভা-ারখ্যাত উত্তরাঞ্চলের সেচভিত্তিক চাষাবাদকে নির্বিঘœ করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই অথচ তিস্তায় পানির অভাবে রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় এখন পানির বড়ই অকাল। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির স্তর দিনে দিনে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এসব জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাহলে এ সংকট কি নিরসন হবে না? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, টর্নেডো ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী।
উল্লেখ্য, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূলে যায়নি। তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের পানি বঞ্চনার বিষয়টি বারবার জানানো সত্ত্বেও ভারত এদিকে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছেন না। বিষয়টি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষেও ভারতের সায় নেই। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দীর্ঘদিন ধরে ভারতের টালবাহানার কারণে হচ্ছে না। আসলে ভারত পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনীতির খেলা খেলছে। দুদেশের মধ্যে প্রবাহিত সব নদীতেই ভারত বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ পানি আসার কথা, তা আসছে না। এ কারণে শুধু পদ্মা নয়, বড়-ছোট সব নদীই তীব্র পানি সংকটের শিকার হচ্ছে।
ভারতের পানি রাজনীতির কবলে পড়ে বাংলাদেশ একদিকে শুকিয়ে মরছে, অন্যদিকে ডুবে মরছে। এ পরিস্থিতির কবে অবসান হবে, আদৌ হবে কি না, কেউ বলতে পারে না। শুধু মনুষ্যসৃষ্ট প্রকৃতিবিরোধী আচরণের কারণে প্রকৃতিও হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ। ফলে প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে বাংলাদেশের মানুষের বাসোপযোগী প্রকৃতি ক্রমান্বয়েই হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে ভারত প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র নদীগুলো এখন পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। শীতের মৌসুম শেষ হতে না হতেই তিস্তায় এখন শুধু ধু-ধু বালুচর। যে খরস্রোতা তিস্তা বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে দুই কূল ভাসিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। যার হিংস্র থাবায় তলিয়ে যায় কৃষকের ফসল, ভেঙে নিয়ে যায় বসতভিটা ফসলি জমি। সেই তিস্তা এখন পানিশূন্য। দেখলে মনে হয় নদী নয়, তিস্তা যেন মরা খাল। মানুষ হেঁটেই নদী পারাপার হচ্ছে নির্বিঘেœ। নদীর বুকে বালুচরে মানুষ চাষাবাদ করছে। সবুজে সবুজে ভরে গেছে নদীর বুক। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে উজানের পানি আটকে রাখায় তিস্তা এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। মূলত ভারত উজানে পশ্চিমবর্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় ব্যারাজ তৈরি করে একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশ অংশে ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী এখন পানির অভাবে মৃতপ্রায়। এমনকি ভারত তিস্তার পানি আটকে ভারত অংশে মহানন্দা নদীতে, জলপাইগুড়ি জেলার দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুরের মালদহ ও কুচবিহার জেলায় সেচ সুবিধা নিচ্ছে। যেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ আটক কিংবা পরিবর্তন করার বৈধতা আন্তর্জাতিক আইনে নেই, সেখানে ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে দীর্ঘদিন ধরে উজানের পানি আটকে দেওয়ায় বাংলা দেশের উত্তরাঞ্চল এখন ধীরে ধীরে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে, যা অনৈতিক এবং বাংলা দেশের মানুষের ওপর এক ধরনের অবিচার।
বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য দীর্ঘদিন ঘরে কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও আশ্বাস ছাড়া কার্যত কোনো কিছুই মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গের নিযুক্ত নদীবিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র প্রায় সাত বছর আগে তিস্তার পানিবণ্টনে পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো ধরনের অসুবিধা হবে না, তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। এর পরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা অজুহাতে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আটকে রেখেছেন। হয়তো তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভোটের আশায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণœ হলেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে দূরে সরে আছেন। কথায় আছে, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। মমতা ব্যানার্জি কি একটু ভেবে দেখবেন, বাংলাদেশের মানুষকে পানির জন্য নিদারুণ কষ্টে থাকতে হচ্ছে। আমাদের এ কষ্ট নিয়ে ভারতের অনেক লেখকই লেখালেখি করেন সত্য। কিন্তু তাদের সে আবেদনেও মমতার মন গলে না। অতিসম্প্রতি ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বাংলাদেশের এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। শুধু উনিই নন, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের সিপিএম সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম বলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়া জরুরি। এত কিছুর পরও মমতা ব্যানার্জি নির্বাক অথচ মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বলেছিলেন, আমার ওপর ভরসা রাখেন। আমরা তো ভরসা রেখেছি। ভরসা রাখা ছাড়া তো আর আমাদের তেমন কিছু করার নেই! তবে, আর কত দিন তার ভরসার ওপর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, তা শুধু তিনিই জানেন। আমরা আশাবাদী, মমতা ব্যানার্জি মানবিক কারণে হলেও বাংলা ভাষাভাষী দুদেশের মানুষের সুসম্পর্কের প্রতীক হিসেবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করবেন।
যদিও বাংলাদেশ সরকার তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় বন্যার পানি ধরে রেখে সেচভিত্তিক চাষাবাদকে নির্বিঘœ করতে ছয়টি খাল খনন প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রকল্প শুধু তিস্তা ব্যারাজ এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উত্তরাঞ্চলের সব খাল ও মরে যাওয়া নদীগুলোকে খনন করে বন্যা এবং বৃষ্টির পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যেন এসব খালের পানি ব্যবহার করে সেচকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ ভূ-উপরিস্থিত পানির ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু উজানের পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা নদীই হুমকিতে যে আছে, তা নয়। এর বাইরে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রও এখন অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। গভীর ব্রহ্মপুত্রে এখন পানির নাব্য কমে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জন্ম নিয়েছে সুবিশাল চর আর চর অথচ বন্যা এলেই ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে দুই কূলের বসতবাড়ি, আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বন্যা এলে মানুষের কষ্টের কোনো শেষ থাকে না। শুধু তিস্তাই নয়, ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখা জরুরি। কিন্তু বাস্তবে একটি নদীতেও পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ নেই। ফলে প্রতিটি নদীতে এখন পানির তীব্র সংকট। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় মাঝেমধ্যেই উজানের পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কথাও শেষ পর্যন্ত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করে উজানের পানির ন্যায্য হিস্যার যে অধিকার, তাকে নিশ্চিত করতে হবে আর কূটনৈতিক তৎপরতা সফল না হলে মুখাপেক্ষী না হয়ে পানির ন্যায্য অধিকারকে নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক আইনের সফল বাস্তবায়নের দিকেই আমাদের এগোতে হবে। ভুললে চলবে না, পানিই জীবন, পানিই মরণ। উজানের অসময়ে পানির চাপে আমাদের ডুবতে হবে আর প্রয়োজনের সময় পানির অভাবে মরতে হবে। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কৃপা নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠায় পানিবণ্টন চুক্তিকে নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক আইনের পথকেই বেছে নিতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
"