সাবরিনা শুভ্রা

  ২৩ মার্চ, ২০১৮

মতামত

দায়িত্বহীনতার কারণে...

দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য পর পর সংঘটিত কয়েকটি অপরাধ বিসংবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তুচ্ছ কারণেও ঘটছে গোলাগুলি ও হত্যাকান্ড। দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। পেটের শিশুর নিরাপত্তাও বিঘিœত হচ্ছে চিহ্নিত অপরাধীদের গোলাগুলিতে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করেছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবদের সামাল না দিতে পারার ব্যর্থতা জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ইদানিং রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড। আমাদের দেশে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষই এ ধরনের কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ এতে জড়িয়ে পড়েছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে অনেকে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং অপহরণের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। নেশার কারণে বিবেক, বুদ্ধি, চিন্তা লোপ পায়; যার ফলে মাদকাসক্তরা যেকোনো অপরাধ করতে দ্বিধা-সংকোচ করে না।

মাদকাসক্তির কারণে অনেকের সুখের সংসারও ভেঙে যাচ্ছে। এক শ্রেণির মাদকাসক্তরা মেধাবীদের হাতে মরণনেশা মাদক তুলে দিয়ে জাতিকে করছেন মেধাশূন্য। যে কারণে ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছে পুরোটাই মেধাশূন্য। দেশের আলোচিত ঐশীর জীবনের নেপথ্যেও রয়েছে মাদকাসক্তির বিরল ঘটনা। অথচ, যারা এ মাদক নির্মূলে কাজ করেন, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যরাও খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসায়ীদের জড়িত থাকায় দিন দিন বিষয়টি প্রসারিত হচ্ছে। দেশে মাদকসেবীর ৮০ শতাংশই যুবক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বন্ধুদের প্রভাবেই তারা জড়িয়ে যাচ্ছেন ভয়ঙ্কর নেশায়।

হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া মাদকসেবীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, তাদের ৬১ দশমিক ৪৭ শতাংশেরই হাতেখড়ি বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে। গত দুই বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিবছরই এ হার বাড়ছে। মাদকাসক্তের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ কৌতূহল। ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ মাদকসেবী কৌতূহলবশত মাদক গ্রহণ শুরু করে। সরকারি হিসাবে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৫০ লাখের কম নয়। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশকে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জানা গেছে, গত চার বছরে দেশে মাদক-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার ২১৫টি। এসব মামলায় মোট আসামি এক লাখ ৭৩ হাজার ৩২৬ জন। ২০১২ সালে মামলা হয় ৪৩ হাজার ৭১৭টি। গত বছর মাদক-সংক্রান্ত বিচার নিষ্পন্ন মামলায় ৪৭ শতাংশ আসামি ছাড়াও পেয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় প্রায় ১২ হাজার ৩০৪ জন মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিচ্ছেন; যাদের বড় একটি অংশ ইয়াবা আসক্ত। এ ছাড়া অনেকেই আসক্ত গাঁজা, হেরোইন ও ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। আসক্ত তরুণ-তরুণীরা অধিকাংশ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইয়াবা পরিবহন ও সেবন তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ায় এর আসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

এদিকে কিশোর অপরাধের আইন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। বাংলাদেশে সাধারণত সাত থেকে ১৬ বছর বয়সীদের কিশোর-কিশোরী বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫-এর (৩) ধারা অনুযায়ী, একজন কিশোরের ১৮ বছর পূর্ণ হলে নাবালকত্বের অবসান ঘটে। দন্ডবিধির ৮২ ধারা অনুসারে, ৯ বছরের কম বয়সী শিশুর কোনো ধরনের অপরাধই আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য নয়। ১৮৭৪ সালের চিলড্রেন অ্যাক্ট অনুসারে অনূর্ধ্ব ১৬ বছর বয়সীদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আবার জামিনের ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের বেলায় আইন অত্যন্ত মানবিক। যেমন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭(১) ধারা অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে যে কাউকে, এমনকি জামিন অযোগ্য অপরাধেও আদালত জামিন দিতে পারবেন। এমনকি ১৬ বছরের নিচে যে কাউকে গ্রেফতার করা হলে এবং সঙ্গে সঙ্গে আদালতে উপস্থিত করা সম্ভব না হলে পুলিশের (ওসি) তাকে জামিন দিতে পারবেন। মূলত, এই আইনগুলোরই এ মানবিকতার সুযোগ নিয়ে থাকে দুষ্টচক্র। এরই পরিণতিতে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। সুতরাং, কিশোর অপরাধে যাতে শিশু-কিশোররা জড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর দিতে হবে।

বর্তমানে শিশু-কিশোরদের গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ মাদকসেবন এবং পরবর্তী সময়ে মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়া। এই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে শিশু-কিশোরদের অপরাধ অনেকটা হ্রাস পাবে। আর শিশু-কিশোরদের সুস্থ বিনোদন যেমন- খেলাধুলা, সংগীত, বইপড়া, শিক্ষাসফর, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ বিনোদনের অভাব থাকলে শিশু-কিশোরদের অতি কোমল স্পর্শকাতর মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেইসঙ্গে অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। জনপ্রিয় সেøাগান ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ বর্তমান প্রজšে§র শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ না ঘটলে জাতির জন্য ভবিষ্যতে মেধাবী নেতৃত্ব পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। সুতরাং, এখনই শিশু-কিশোরদের মঙ্গল ও কল্যাণের ব্যাপারে রাষ্ট্র তথা সরকার এবং অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist