সোলায়মান মোহাম্মদ

  ২৩ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

ভাষায় মিশ্রণ শোভনীয় নয়

‘জানোই তো, কালকে টুয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি, সেলিব্রেট না করলে হয়। আফটার অল, এই দিনের আলাদা একটা ইম্পরট্যান্স আছে না? আরেহ, ইন দ্য ইয়ার নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, এই দিনেই তো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডার্কনাইটে আর্মস নিয়ে আমাদের মাম্মি ড্যাডিদের ওপর অ্যাটাক করেছিল। রফিক, জব্বারসহ অনেকেই তাদের লাইফ সেক্রিফাইজ করেছিল...’

কথাগুলো খুব রসিয়ে এক মেধাবী বন্ধু বর্তমান সমাজের বাস্তবচিত্র ব্যঙ্গ করে তার ফেসবুকে লিখেছিলেন। কথাগুলো যে শতভাগ সত্য, তা কাউকে চিমটি কেটে বুঝাতে হবে না। মিটিং-মিছিলে, অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে এমনকি বাংলা ভাষার তাৎপর্য নিয়ে টিভি টকশোতেও আলোচনার সময় এমন রঙ তামাশা চলছে অবিরাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গিয়ে বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে দু-চারটা ইংরেজি না ফাটালে নিজেদের আর এখন যোগ্যই মনে হয় না, এমন অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়েছি। নিজেদেরকে বিখ্যাত করার জন্যই মূলত আমাদের অনেকেই ভাষার সঙ্গে এমন আচরণ করে থাকেন।

একজন বিখ্যাত মানুষের কথা না বলে পারছি না। খুব সম্ভবত ২০০৬ সালে বিশ্বখ্যাত ফুটবল তারকা জিনেদিন জিদান বাংলাদেশে এসেছিলেন। গাজীপুরের মজলিশপুরেও তিনি নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের সঙ্গে একটি আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন। মজলিশপুর স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দ করে ফুটবলও খেলেছিলেন। আমি তখন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে পড়ি। পাশেই একটি ছাত্রাবাসে থাকি। কয়েকজন বড় ভাই বললেন, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হও পাশের এলাকায় ফুটবলের জাদুকর জিনেদিন জিদান আসছেন, আমরা যাচ্ছি সবাই। চোখের পলকে রুম থেকে দৌড়ে বের হলাম তাকে দেখার উদ্দেশে। মজলিশপুর যেয়ে দেখি হাজারো মানুষের ঢল, কৃষকের পাকা ধান ক্ষেতের বারোটা বাজিয়ে মানুষজন উপচে পড়ছে এক নজর জিদানকে দেখতে। আমরাও তাই করলাম। জনস্রোত মাড়িয়ে, পুলিশের বাধা ডিঙ্গিয়ে জিদানের মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম। কথা বলার সৌভাগ্যও হয়েছিল। প্রায় ছয়-সাত মিনিট জিনেদিন জিদানের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। অবাক করা বিষয় হলো আমি ইংরেজীতে প্রশ্ন করলেও তিনি একটি প্রশ্নের জবাবও ইংরেজিতে দেননি। তিনি ফ্রান্সের ভাষায় কথা বলেছিলেন, একজন ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে ইংরেজী না বলার কারণ জিজ্ঞেস করাতে তার ব্যক্তিগত সহযোগী উত্তর দিলেন, জিদান সচরাচর নিজের ভাষা রেখে অন্য ভাষা ব্যবহার করেন না। এমনকি খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা একেবারেই বলেন না।

সিনেমা জগতের রোল মডেল বলিউড বাদশা শাহরুখ খানসহ পৃথিবীর আরো অনেক বিখ্যাত মানুষই রয়েছে; যারা টিভি উপস্থাপনা বা কোনো আলোচনায় এসে অহেতুক মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলেন না। কিন্তু খুব দুঃখ হয় যখন দেখি আমাদের দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো একজন ব্যক্তি ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণ এমনভাবে করছেন, যা শুনলেও বিরক্ত লাগে। খুব রাগ হয়েছিল যেদিন দেখলাম তিনি বাজেট পেশ করছেন অথচ দুই ভাষার সংমিশ্রণে। কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের জন্য পাশ করা ওই বাজেট যদি ইংরেজিতে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দেশের কতজন সাধারণ মানুষ তা বুঝবেন, বোধগম্য নয়।

তরুণরা কোথায় শিখবে কার কাছে শিখবে? তা সত্যিই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এমনিতেই আমরা নতুন প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছি ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুন (২১ ফেব্রুফারি) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র ও প্রগতিশীল মানুষের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ আরো নাম না জানা অনেকের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠা ঢাকার রাজপথের সেদিনের সেই ইতিহাস। অসংখ্য জীবন দিয়ে অর্জিত যে মায়ের ভাষা আমরা অর্জন করেছি তার মান আমাদেরই রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না ইংরেজি যেমন আন্তর্জাতিক ভাষা তেমনি সারা বিশে^র সব দেশের ভাষাকে রেখে কেবলমাত্র আমাদের মাতৃভাষাকেই ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেছে। তারপর থেকেই বিশে^র সব দেশ এই ভাষার সম্মানে এ দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। ভুলে গেলে চলবে না সম্প্রতি এই বাংলা ভাষায় দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণকে বিশে^র গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। সুতরাং, ভাষা নিয়ে যদি গর্ব করতে হয়, তাহলে বাংলা ভাষা নিয়ে বিশে^ শুধুমাত্র আমরাই গর্ব করতে পারি।

তবে ইংরেজি বলা যাবে না বা বলা নিষেধ এমন কিন্তু কখনো বলা হয়নি। কেউ ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় পারদর্শী সেটা আরো গর্বের বিষয়। কিন্তু মিশ্রণ করে কেন? যখন যে ভাষা ব্যবহার করা হবে তার সম্পূর্ণ বাক্যই কিংবা পুরো অনুষ্ঠানই যেকোনো একটি নির্ধারিত ভাষায় পরিচালনা করলেই হলো। অন্ততপক্ষে একটি সম্পূর্ণ বাক্য একটি ভাষায় হতে পারে। ইংরেজি বলার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। যেমন, ইংরেজি শেখার আসরে বাংলা বলবে কেন? শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি পাঠদানের সময়ে শিক্ষক বাংলা বলবে কেন? তাছাড়া যারা ইংরেজি জানে না তাদের সঙ্গে বাংলা বলে লাভ কী। নিজের দেশকে বাইরের দেশে উত্তীর্ণ করতে ইংরেজি বলবে সেখানে বাংলা বললে কে বুঝবে। ইংরেজি শিখতে ও শেখাতে উভয় ক্ষেত্রে একটি বাংলা শব্দও ব্যবহার না করাই শ্রেয়। ইংরেজি আমাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষা এবং বিশে^ সর্বাদিক পরিচিত ও ব্যবহৃত ভাষা সেদিক থেকে এর গুরুত্বও অপরিসীম। তাই এ ভাষাও আমাদের আয়ত্ত করা জরুরি।

একটি কথা না বললেই নয়, ভাষা নিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজে যা শুরু হয়েছে তাতে সব ভাষাকেই অসম্মান করা হচ্ছে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণে ইংরেজি ভাষাকেও খাটো করা হচ্ছে। আর আমাদের মাতৃভাষাকেও ধ্বংসের ধারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকার ইচ্ছা করলে এ বিষয়ে রেডিও ও টিভি অনুষ্ঠানমালার ভাষাগত নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আসুন, শুদ্ধ ও খাটি বাংলার চর্চা করি। যতটা সম্ভব, যেখানে সম্ভব বাংলা বর্ণমালাকে স্থান দিয়ে শহীদদের সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে নিজেরা সম্মানিত হই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist