শামীম শিকদার

  ২২ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই

প্রায় প্রতিদিনই সড়কে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করেছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। তবু কোনোভাবে কমানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা। বরং দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। তার জন্য যেমন নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ, তেমনি নেই সচেতনতা।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ এ সময়ে প্রতি বছর গড়ে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। পরের চার বছরে এ গড় কমে প্রায় দুই হাজারে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৃত দুর্ঘটনার সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেশি। পুলিশের হিসাবে দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) তথ্য মতে, ২০১৫ সালে সারা দেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার তিন জন মারা যান, আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। আর ২০১৪ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২ হাজার ৭১৩টি। এতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮২ জন। ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হন। এ সংখ্যা ৩৫৯। এর মধ্যে রাজধানীতেই নিহত ২২৭ জন আর সবচেয়ে কম ২৮ জন মারা যান কুষ্টিয়া জেলায়। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে সারা দেশে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হন; আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। আর ভিন্ন এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের একটি সূত্রে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজার লোক পঙ্গু হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ২০১৫ সালে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪৭ হাজার ৪৩৭ জন এবং ২০১৪ সালে ৪৬ হাজার ৫৮৪ জন চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। পরিসংখ্যান যাই বলুক আমাদের দেশে যে মানুষের একটি বড় অংশের অকালমৃত্যুর কারণ যে সড়ক দুর্ঘটনায় এটা অস্বীকার করার উপায় বোধ হয় কারোই নেই।

এক সূত্রে জনা যায়, বাংলাদেশে লাইসেন্সকৃত গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখের বেশি এবং অবৈধ গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ (নসিমন, করিমন, ভটভটি, অটোবাইক ও ট্রলি)। এই হিসাবে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা হলো ৪৯টি। অথচ প্রতি ১০ হাজারে আমেরিকায় দুটি, জাপানে দুটি, চীনে সোয়া তিনটি ও রাশিয়ায় চারটি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, সারা দেশে লাইসেন্সবিহীন অবৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। আর ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, মিনিবাস, টেম্পো, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি রয়েছে চার লাখের মতো। পরিবহন সংগঠনগুলোর প্রভাবশালী নেতারা পুলিশ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সড়ক-মহাসড়কে নির্বিঘে গাড়ি চালাচ্ছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সড়কে নানান ধরনের অনিয়ম ও অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়তিই বেড়ে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। চালক, যাত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথার্থ সচেতনতার অভাবে পথে পথে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। যার যার খেয়ালখুশিমতো সড়কে চলাচলের ফলে যেমনভাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঠিক তেমনভাবেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়। অসচেতনতার কারণে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সৃষ্টি নানান ধরনের বিব্রান্তির। মানুষ পথে পথে শিকার হচ্ছে অহেতুক হয়রানির। জনজীবনে সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরনের আতঙ্ক। ২০০৯ সালে এআরআই রাজধানীর দুর্ঘটনারোধে ঝুঁকিপূর্ণ অর্ধশতাধিক ব্ল্যুাক স্পট চিহ্নিত করে সেগুলোকে মেরামতের সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠায়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টের মধ্যে ছিল ফার্মগেট, সোনারগাঁও, বিজয় সরণি, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, জিপিও মোড়, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, সায়েদাবাদ ইত্যাদি। কিন্তু একাধিক নগর কর্তৃপক্ষ থাকা সত্ত্বেও এত দিন পরেও এ পর্যন্ত সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্ল্যুাক স্পট সুপারিশ বাস্তবায়ন ছাড়াও ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্তকরণ, ট্রান্সপোর্ট কমিশন গঠন, যথাযথ আইন প্রয়োগ ও কোম্পানির মাধ্যমে গাড়ি চালানোসহ চালক-যাত্রী-পথচারীদের সচেতন করা গেলে রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

এ ছাড়া রয়েছে অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা, দুর্নীতি, চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ভঙ্গুর সড়ক, ওভারটেকিং, অতিরিক্ত গতি, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, ট্রাফিক আইন অমান্য, ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালক, বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং যথাযথ আইন ও আইনের প্রয়োগের অভাবসহ বিবিধ। অসচেতনতার কারণে ওপরের প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটে থাকে। অদক্ষ, অযোগ্য, অশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের মধ্যে অসচেতনতা থাকবে এটি স্বাভাবিক। তাই সরকারের উচিত চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আরো বাড়ানো। কারণ শিক্ষাই চালকদের সচেতন করতে পারে। এ ছাড়া অনেক চালক আছেন, যারা গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলে থাকেন, যেটা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উপরোক্ত কার্যকর পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি প্রশাসন, চালক ও জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক কিশোর আনন্দ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist