আবু তালহা তারী

  ২০ মার্চ, ২০১৮

শিশু

অধিকার রক্ষার দায়িত্ব কার

পরম ভালোবাসায় যার শৈশব শুরু হওয়ার কথা, যে শিশু কচি মুখের বোলে মা-বাবাকে ডাকবে। কিন্তু সে মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা বোঝার আগেই মিল-কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, মাঠঘাট এবং হাটসহ সর্বস্থানে শ্রমের কোদাল হাতে নির্দয় জীবনের ঘানি টানছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধনসম্পদ ও শিশুরা পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সুরা কাহাফ : ৪৬)

পৃথিবীর জমিনে দুঃখ নিয়ে জন্ম এই শিশুদের। জগৎ সংসারের যোদ্ধা এই শিশু। এই শিশু খেলবে, হাসি-উল্লাসে আকাশের ঘুড়ির মতো ঘুরবে। যাকে শেখানো হবে অজানা পৃথিবীর রহস্য। অথচ সে শিশু মায়ের কোলে না ঘুমিয়ে গড়াগড়ি খায় ধুলোময় ফুটপাতে। প্রখর রোদে মাথার ওপর কোনো ছায়া নেই। বৃষ্টির পুরোটাই তাদের ধারণ করতে হয়। এই শিশুর বাবা-মা দরিদ্র ও তাদের কর্মহীনতার কারণে একমুঠো ভাতের জন্য মিল-কারখানায় কাজ করে। রাস্তার পাশে হোটেল-রেস্টুরেন্টে ও চায়ের দোকানে দেখা যায় অল্প টাকার বিনিময়ে তাদের দ্বারা অমানবিক কাজ করানো হচ্ছে। রেস্টুরেন্টে কর্মরত এক শিশুকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার বেতন কত? সে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ রইল, আবার ক্যাশ কাউন্টারের দিকে তাকাল কেউ শুনতে পায় নাকি! আমি আবার জিজ্ঞাসা করলে সে বলল তিনবেলা খাবার হচ্ছে আমার বেতন। অথচ মালিক তাকে সব ধরনের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অধিক কাজ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাদের সামর্থ্যরে অধিক কাজ করতে চাইলে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করো এবং তাদের ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দিও না’। (বোখারি শরিফ)

অন্যদিকে সুঠামদেহী সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তি বাজারের বোঝা বহন করতে না পারায় সে বোঝা শিশুদের মাথায় ১০ টাকার বিনিময়ে উঠিয়ে দেয়। দেরি হলে বা আস্তে হাঁটলে ছোট অবোধ শিশুটিকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আবার গৃহকর্ত্রীরা বাসার কাজের অবোধ অসহায় কাজের মেয়েশিশুটিকে একটু অন্যায় পেলে রুটিনমাফিক প্রহার করে। সেই অবোধ অসহায় শিশুটি অন্য কোথায় চলে যেতে চাইলে তাকে রুমে আটকে তালা মেরে রাখা হয়। সেই অবোধ অসহায় শিশুটি জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে তার বয়সি ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি দেখে এবং তার বাবা ও মায়ের কথা মনে করে। মনে হয় এটা তার জন্য ছোট একটি জেল। গৃহকর্তার ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও সে কেন অসহায় নির্বোধ শিশুটির ওপর অত্যাচার করে? দুঃখ হয়, কষ্ট হয় যারা শিক্ষিত হয়ে অশিক্ষিতের মতো কর্মকা- করেন। শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার বন্ধ এবং শিশু হত্যা বন্ধ এসবÑসেøাগান দিয়ে এই নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রকৃত চেতনার উন্মেষ ঘটবে, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে আমরা সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে না পারব এবং পরস্পরের যে হক বা অধিকার সর্বজনীন জীবনাদর্শ ইসলাম নিশ্চিত করেছে, তা সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব মায়াকান্না নিষ্ফল হয়ে যাবে। পত্রিকার পাতায় ও মিডিয়াতে চোখ রাখলেই প্রতিনিয়ত দেখা যায়, শিশু নির্যাতনের এক করুণ চিত্র। শিশু অপহরণ, শিশুর মুক্তিপণ দাবি আবার বা শিশুর গলাকাটা লাশ উদ্ধার। এ যেন এক দৃশ্য। অথচ শিশুদের হত্যা করতে মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর মতে, শিশুশ্রম হলো পনেরো বছরের নিচে শিশুদের মজুরির বিনিময়ে এমন নিয়মিত শ্রমে যুক্ত করানো, যা তাদের স্কুলে যাওয়া কিংবা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যে শিশু আমাদের মধ্যে খেলবে, হাতে থাকবে বই-খাতা-কলম, কাটাবে হাসি-উল্লাসে, কিছু না দিলে সে আভিমান করে কান্না করবে, যে শিশু বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবেশ থাকবে পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর। কিন্তু সেই শিশু মায়ের কোলে ঘুমাতে না পেরে ঘুমিয়ে থাকে ময়লাযুক্ত রাস্তার পাশে। যে বন্ধুদের হাত ধরে খেলবে, সেই হাত দিয়ে তারা আজ রিকশা চালায়, হাতুড়ি পিটিয়ে ইট ভাঙে, গ্যারেজে কাজ করে। একমুঠো ভাতের জন্য তাদের কম মজুরি দিয়ে বেশি কাজ করানো হয়। যা শিশুদের মনের জন্য ক্ষতিকর। ইসলামে শ্রমনীতিমালা অনুসারে কারো ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নিষেধ করা হয়েছে।

শিশুশ্রমের মূল কারণ হলো দারিদ্র্য। দরিদ্র বাবা এবং মা সংসারের ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হয়ে পড়ায় বা তাদের কর্মহীনতার কারণে বাবা এবং মায়ের স্থলে শিশুরা অর্থ উপার্জনে অগ্রসর হয়। কিন্তু তাদের এই দুর্বলতার সুযোগে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী মানুষ শিশুদের দিয়ে হরতাল, পিকেটিং, ভাঙচুর ও তাদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ডাকাতি, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্মে লাগানো হয়। এ ধরনের কাজ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিশুদের নিপীড়নমূলক কাজ থেকে মুক্তি দিতে ধর্মীয় সচেতনতাসহ সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকাররিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শিশুরা সামর্থ্যরে অধিক কাজ করতে চাইলে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করো এবং তাদের ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দিও না।’ (বোখারি শরীফ)

শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের সব দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। শিশুদের অধিকার এবং উত্তম আচরণ দ্বারা আদর্শ মানুষ তৈরি করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইসলামও শিশুদের অধিকার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। শিশুদের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো অবস্থাতে কাজ করানো যাবে না। সর্বদা তাদের প্রতি দয়ামায়া দেখাতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।’ (বোখারি শরিফ)

নৈতিক শিক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ধর্মীয় পরিবেশ না পেলে শিশুর যথার্থ বিকাশ হয় না। শিশুদের শিক্ষাদান করতে হবে যেন তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সফল হয়। শৈশব থেকে সন্তানকে উত্তম আচার-আচরণ শিক্ষা দিয়ে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুসন্তান হলো কাদামাটির মতো। শিশুদের শৈশবে যেমন ইচ্ছে তেমন গড়ে তোলা সম্ভব। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সন্তানদের আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া সম্পদদান করা অপেক্ষা উত্তম।’ (বায়হাকি)। শিশুরা হলো মহান আল্লাহর বড় এক নিয়ামত এবং পিতা-মাতার জন্য আমানত। শিশুর মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘শিশুরা হলো জান্নাতের প্রজাপতি’। (মিশকাত শরিফ)। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে দুধপান করানো মাতার অপরিহার্য কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে শিশুকে মায়ের দুধপানের বিষয়ে বহু নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘যেসব জননী দুধপান করানোর মেয়াদপূর্ণ করতে চায়, তারা যেন নিজেদের সন্তানদের পুরো দু’বছর দুধ পান করায়।’ (সুরা বাকারা : ২৩৩)। কোরআনের নির্ধারিত সময়সীমা তথা দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দুধ ছাড়িয়ে নিতে পারবে। তবে স্বামী-স্ত্রীর আলোচনার মাধ্যমে ও শিশুর ক্ষতি যদি না হয়।

সর্বোপরি শিশুদের অধিকার রক্ষা করে শিশুশ্রম বন্ধ করে দিয়ে সমাজে বেঁচে থাকা সব শিশুদের নিজেদের মনে করে অবহেলা না করে শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসাসহ সব সুযোগ সুবিধা করে দিতে হবে এবং শিশুদের সর্ব-অবস্থায় সাহায্য করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদের সাহায্য করো ও ভালো ব্যবহার করো এবং তাদের সুশিক্ষা দাও।’ (তিরমিযি শরিফ)।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist