আখতার হামিদ খান
পর্যালোচনা
স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি ‘সলঙ্গা’
বাঙালিরা জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ। এই সুমহান অর্জনের পটভূমি আলোচনা করতে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে চলে আসে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯। স্পষ্ট বললে, মহান ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের নির্যাতনের ইতিহাস। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের ইতিহাস, সংকল্পের ইতিহাস, সর্বব্যাপী প্রতিরোধ এবং প্রেরণার ইতিহাস। সব মিলিয়ে মুক্তিকামী বাঙালি বীর সন্তানদের আত্মদানের গৌরবগাথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে আরম্ভ হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে। এ যুদ্ধের সরাসরি বিস্তৃতি ঘটে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই নয় মাসের সংগ্রাম ছিল সশস্ত্র জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। অতুলনীয় ত্যাগ অপূর্ব বীরত্ব, সাহস আর প্রাণদানের সু-বিশাল ঐশ্বর্য এ সংগ্রামকে করেছে চির মহিমান্বিত। এই ত্যাগের চেতনা বাঙালি জাতির একদিনে গড়ে ওঠেনি। সুদীর্ঘকাল থেকে সংগ্রাম, আন্দোলন আর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বেড়ে ওঠে। একের পর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বিবর্তনের ধারায় একাত্তরে পৌঁছে।
বিদেশি শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে সব সময়ই অধিকার আদায়ে লড়েছে বাঙালি। সৃষ্টি করেছে বীরত্বগাঁথা ইতিহাস। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সূর্য সন্তানরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তবে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনই সবচেয়ে বেশি গৌরবগাথা এবং সংঘবদ্ধ। বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম উন্মেষ এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন সূচিত হয় ইংরেজবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরেই। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের বীর সেনা ফরায়েজি আন্দোলনের জনক হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র প্রমুখরা একেকটি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন একেকটি রক্তসিঁড়ি। তারা আমাদের অহঙ্কার, আমাদের অনুপ্রেরণা। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন নবাবের পতনের পর যখন ইংরেজ শক্তির আগমন ঘটে, তখন থেকেই আন্দোলনের সূচনা ঘটে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি জনগোষ্ঠী বারবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এই ‘বিদ্রোহ’ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা আন্দোলনেরই অনুষঙ্গ। কয়েকটি বিদ্রোহ উল্লেখ করা যায় : উত্তরবঙ্গে মজু শাহর নেতৃত্বে ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), ত্রিপুরায় শমসের গাজী বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), বাকেরগঞ্জ বালাকী শাহর বিদ্রোহ (১৭৯২), ময়মনসিংহে পাগলপন্থিদের বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭), নীলচাষিদের সংগ্রাম দ্বিতীয় দফা (১৮৩০-৪৮), তিতুমীরের লড়াই (১৮৩১), দক্ষিণবঙ্গে ফরায়েজি আন্দোলন (১৮৩৮-৪৮), ওহাবি আন্দোলন (১৮৩০-৭০), সিপাহি বিপ্লব (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ (তৃতীয় দফা (১৮৫৯-৬১), মুনশী চাঁদ মিয়ার নেতৃত্বে সন্দ্বীপে ৪র্থ কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭০), ‘সিরাজগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩) প্রভৃতি অন্যতম। তা ছাড়া সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের মতো আরো অনেক বিদ্রোহ ও আন্দোলন রয়েছে। বাংলার প্রতিটি অঞ্চল থেকেই আন্দোলন রয়েছে। বাংলার প্রতিটি অঞ্চল থেকেই আন্দোলন এসেছে বিভিন্ন নামে-পৃথক পৃথক নেতৃত্বে, তবে সবার উদ্দেশ্য ছিল একই সূত্রে গাথা। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের রক্তবেদীতে দাঁড়িয়ে অতীতের সংগ্রাম আর সংগ্রামী দিনগুলোকে তুলে আনতে হবে।
নতুন প্রজন্মকে মূল্যবোধসম্পন্ন হিসেবে বেড়ে তুলতে বিশেষভাবে জানাতে হবে, শেখাতে হবে, পড়াতে হবে, সেই আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিহাসকে। তাহলে আমাদের শিশুরা দেশজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গভীর দেশপ্রেমে বিকশিত হবে। তবে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, সে কাজ আমরা কমই করছি। একটা নির্দিষ্ট ছকে আমরা বন্দি হয়ে পড়েছি। দলীয় শেকলে বেঁধে ফেলছি আমাদের জাতীয় অর্জনকে। প্রচারের অভাবে আমাদের অনেক অর্জন হারিয়ে গেছে একেবারেই। ইংরেজবিরোধী আন্দোালনে অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ সেই সলঙ্গা বিদ্রোহের কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। গ্রাম্য সহজ-সরল, অহিংস শত-সহস্য মানুষের রক্তে রঞ্জিত সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থানার সলঙ্গাকে কি আমরা কখনো ভুলতে পারব?
ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের কথা আমরা সবাই জানি কমবেশি। সেই হত্যাকা-ের কারণে বিশ্বকবি রবিঠাকুর ইংরেজ সরকার প্রদত্ত তার ‘নাইট উপাধি’ বর্জন করেছিলেন। রবিঠাকুরের নাইট উপাধী বর্জনের কারণে মূলত সেই লোমহর্ষক হত্যাকা-ের বিশ্বব্যাপী প্রচার পেয়ে যায়। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল সলঙ্গার হাটে। প্রচারের অভাবে বাঙালি সমাজের ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে সেই আত্মত্যাগ বিস্মৃত হয়ে আছে।
সলঙ্গা হত্যাকা-ের প্রায় শত বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু বংশ পরম্পরায় স্থানীয় মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষ বীর শহীদদের আজও স্মরণ করে পৃথক মর্যাদায়। সলঙ্গা বিদ্রোহে ঠিক কত মানুষ হত্যা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যা নেই। তবে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার চার হাজারের অধিক নাগরিক হত্যার কথা স্বীকার করেছিল। আর কত যে অবলা গবাদি পশু হত্যা হয়েছে তার হিসাব নেই। ১৯২২ সালে জানুয়ারি মাসে পাবনা-বগুড়া সীমান্তের চান্দাইকোনায় সাপ্তাহিক মঙ্গলবারের হাটে স্বেচ্ছাসেবকদের বয়কট অভিযানে কয়েকজন পুলিশ বাধা দেয়। এতে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয়। পুলিশ এই এলাকায় কংগ্রেসকর্মী ও জনসাধারণের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সলঙ্গা হাটে তাদের অভিযান চলে। আকস্মিকভাবে শুক্রবারের সলঙ্গার হাটে উপস্থিত হন পাবনার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আর এন দাস, সিরাগঞ্জ মহকুমার এসডিও সুনীল কুমার সিংহ, পাবনা জেলার ব্রিটিশ পুলিশ সুপার এবং ৪০ জন আর্মড পুলিশ। তখন ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবক হাটে কাজ করছেন অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে। বিলেতি পণ্য বর্জনের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। স্বেচ্ছাসেবক নেতা তরুণ আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (তখনো মাওলানা ও তর্কবাগীশ উপাধিপ্রাপ্ত হননি) হাটের কংগ্রেস অফিসে বসা। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ দল তর্কবাগীশকে পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আগে থেকে তিনি পুলিশের খাতায় অভিযুক্ত ছিলেন। কালবিলম্ব না করে অহিংস নেতা তর্কবাগীশকে নির্দয়ভাবে মারা হলো। তা নাক-কান ফেটে দেহের নানা অংশ ক্ষত-বিক্ষত রক্ত ঝরতে থাকল। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
আহত তর্কবাগীশকে পুলিশ সুপার গরুর মতো টেনেহিঁচড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন জনতার ভিড়ের মধ্য দিয়ে। তখন অবশ্য তার জ্ঞান ফিরেছে। প্রিয় নেতার করুণ দৃশ্য দেখে জনতা সহ্য করতে পারেনি। জনৈক এক ব্যক্তি ‘নড়ি’ দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। ইংরেজি সাহেবের টাক-মাথা বেশ খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। উভয়েই পৌঁছলেন ম্যাজিস্ট্রেট ও এসডিওর কাছে। ‘মার খাবো, কিন্তু মারব না’Ñএই দীক্ষায় বিশ্বাসী তর্কবাগীশ পুলিশ সুপারের অবস্থায় বিব্রতবোধ করলেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশ সুপারও সাময়িক জ্ঞান হারালেন আঘাতের কারণে। যখন পুলিশ সুপারকে হাটের এক দোকানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল, তখনই লাখো নিরস্ত্র জনতা তর্কবাগীশকে মুক্ত করার জন্য ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্রও ছিল না। জনতা এতটাই বিক্ষুব্ধ ও মারমুখী ছিল তাদের শান্ত করার কোনো সুযোগই থাকল না তর্কবাগীশের জন্য। ৪০ জন আর্মড পুলিশ গুলিভর্তি রাইফেল জনতার দিকে তাক করে বসল। ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশ সুপার নির্দেশ দিলেন ‘ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠল আর্মড পুলিশের রাইফেল। চলল অবিরাম গুলিবর্ষণ। হাজার হাজার আদম অহিংস বাঙালি সন্তানের তাজা শরীর নিথর হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। লুটিয়ে পড়ল বোবা প্রাণী ছাগল ভেড়া গুরু-মহিষ। মানুষ আর পশুর রক্তক্ষীণ সলঙ্গা নদীতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ৪০ জন আর্মড পুলিশের মধ্যে একজন বিহারি ক্ষত্রিয় সদস্য ব্যতিক্রম ঘটনার জন্ম দিলেন। তিনি একটিও গুলি খরচ করেননি। পুলিশ সুপারের রাগতস্বরে জিজ্ঞাসার জবাবে পশু হত্যা সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘ও হামারা মাতা হ্যায়’।
অন্যদিকে এই ধ্বংসযজ্ঞের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা ফালা, লাঠি, হলঙ্গা, সুরকি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে হত্যাকারীদের ঘিরে ফেলে। প্রচার হয়ে যায় তর্কবাগীশকে হত্যা করা হয়েছে। অবস্থা বেগতিকে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট তর্কবাগীশকে মুক্ত করে দিয়ে জনতাকে শান্ত করতে অনুরোধ করেন। তর্কবাগীশ বহু কষ্টে জনতাকে শান্ত করেন। উত্তেজিত জনতা তখন সমস্বরে বলতে থাকে, ‘গান্ধী রাজাকে খবর দেন তিনিও যেন সৈন্য পাঠায়’। তর্কবাগীশ জনতাকে বলেন, গান্ধী সাহেবের সৈনিক তো তোমরাই, তিনি সৈন্য পাবেন কোথা থেকে? অহিংস অসহযোগের প্রতি নিষ্ঠা ও অবিচল আস্থার কারণে তর্কবাগীশ সেদিন প্রাণে রক্ষা করলেন পাশবিক বর্বর হত্যাকারীর। সলঙ্গা ট্র্যাজেডির পর পরিস্থিতি আরো বেদানার্ত হয়ে ওঠে। স্বজনরা কান্না, আহতদের যন্ত্রণায় কাতরানো, লাশের স্তূপ, শোকের মাতম দেশজুড়ে। প্রতিবাদ বিক্ষোভের রেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষে। আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে সব পরিস্থিতিই সামাল দিতে হয়েছে তর্কবাগীশকে। কারোর গাড়ি থেকে গরু-মহিষ, কারোর কাছ থেকে গাড়ি আনা হলো। জোর করে আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে তাদের নিয়ে ঠেলাগাড়িতে বোঝাইকৃত লাশের ওপর আহতদের বেঁধে হাসপাতালে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।
ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ ও হত্যাকা- উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান উজ্জীবক ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের চেতনায় কতটা সমুজ্জ্বল সলঙ্গা। আমাদের সরকারগুলো কিংবা আমরা কেউ কি মনে রাখতে পেরেছি সেই রক্তদানের কথা। সলঙ্গার বীর শহীদদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া কি আবশ্যিক ছিল না? শহীদদের সম্মানে একটা স্মৃতিস্তম্ভও সলঙ্গা হাটে নির্মিত হয়নি এ পর্যন্ত! সলঙ্গা হাটের ছোট্ট বটগাছের চারাটি বর্তমানে বিশাল বটগাছে পরিণত হয়ে নৃশংস-বর্বর হত্যাকান্ডের কালের একমাত্র নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট
"