এটিএম মোসলেহ উদ্দিন

  ১৭ মার্চ, ২০১৮

মতামত

বিমান দুর্ঘটনা ও কিছু কথা

প্রায় ৩৪ বছর পর বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলো বাংলাদেশি বিমান সংস্থার বিমান। গত সোমবার (১২ মার্চ) স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে নেপালের রাজধানী ও পার্বত্য শহর কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিএস২১১ ফ্লাইটের ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ঢাকা থেকে যাওয়া ৭৮ আসনের এই বিমানটিতে দুজন পাইলট, দুজন ক্রুসহ ৭১ জন যাত্রী ছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমের সূত্র মতে এখন পর্যন্ত ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন মৃত্যুবরণ করেছে। বাকিরা কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর আগে ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আসার সময় বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের ফকার এফ-২৭-৬০০ মডেলের একটি বিমান বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি জলাশয়ে বিধ্বস্ত হলে পাইলট, ক্রুসহ ৪৯ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। বর্তমানে কাঠমান্ডুর দুর্ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নিহতদের সম্মানার্থে সরকার বৃহস্পতিবার (১৫ মার্চ) রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে ও শুক্রবার (১৬ মার্চ) সারা দেশে সব ধর্মীয় প্রার্থনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নেপালের একটি সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে ইউটিউবে আপলোডকৃত এটিসির (এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোল) সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের রেকর্ড সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তা শুনে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের এটিসি টাওয়ারের ভুল নির্দেশনাকে ওই দুর্ঘটনার জন্য সন্দেহ করেছেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বৈমানিকরা বলছেন, এটিসির নির্দেশনার ফলে ককপিট বিভ্রান্ত হয়েছে এবং এটি এটিসির ভুল। তাদের ভুলের কারণে এমন মারাত্মক মাশুল দিতে হলো কতগুলো তাজা প্রাণকে। নেপাল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ছয়জন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অফিসারকে বদলি করেছে, যা ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ ও বৈমানিকদের সন্দেহকে আরো জোরালো করে তুলেছে। এই অডিও ভয়েস শুনে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন যে অল্প সময়ের মধ্যে এটিসির দুই ধরনের নির্দেশনার কারণে পাইলট হয়তো বিভ্রান্ত হয়েছেন।

দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটির ধ্বংসস্তূপ থেকে বিমানের ব্ল্যাকবক্স ও কথোপকথনের রেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ। ইতোমধ্যে নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গত মঙ্গলবার (১৩ মার্চ) থেকে কমিটি কাজ শুরু করেছে। ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত করবে। সেই সঙ্গে বিমান তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান কানাডিয়ান বোম্বার্ডিয়ার কর্তৃপক্ষ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ বিমান চলাচলবিষয়ক অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তদন্তে অংশ নেবেন। আমাদের চাওয়া এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসুক ও তার প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

পৃথিবীর সব দেশে যখন বিমান চলাচল আরো নিরাপদ করার কাজ চলছে, নেপাল তখন প্রতিনিয়ত বিমান দুর্ঘটনার জন্য শিরোনাম হচ্ছে। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের (এএসএন) তথ্য মোতাবেক সোমবারের দুর্ঘটনাসহ গত আট বছরে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) নয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বৈমানিকদের মতে, কাঠমান্ডুর বিমানবন্দরে বিমান নামানোর ক্ষেত্রে পাইলদের সব সময় চ্যালেঞ্জের মুখে থাকতে হয়। সেখানে রানওয়ের এক প্রান্তের ঠিক পেছনেই পাহাড়, পাহাড় পেরোনোর পর খুব দ্রুত পাইলটকে বিমান নামাতে হয় রানওয়েতে। রানওয়ের একপাশে কিছুটা সমতল জায়গা রয়েছে, আরেক পাশে রয়েছে গভীর খাঁদ। যার কারণে এটি বিশ্বের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশটি খুবই সুন্দর কিন্তু অসমতল ভূমির কারণে সেখানে বিমান পরিচালনা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়, যখন নেপালের অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলো পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজ ব্যবহার করাতে। এ ছাড়া নেপালের সব এয়ারলাইনস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় নিষিদ্ধ। কারণ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকর্তারা নেপালের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ও নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস করে না বলে জানিয়েছে ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এয়ার সেফটি লিস্ট’ হলো একটি বিপজ্জনক বিমান সংস্থার নামের তালিকা। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিমান সংস্থাগুলো বেশির ভাগই খুবই স্বল্প পরিচিত ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদ- বা সেফটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে অক্ষম। নেপালের ১৭টি এয়ারলাইনসের সবগুলোই এ তালিকায় রয়েছে।

এএসএনের তথ্যানুযায়ী সারা বিশ্বে ২০১৭ সালে বড় ধরনের কোনো বিমান দুর্ঘটনা না ঘটায় বছরটি ছিল বিমান চলাচলের একটি নিরাপদ বছর। কারণ ২০১৭ সালে বিশ্বের কোথাও কোনো যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেনি, যা আস্থা ও স্বস্তি এনে দিয়েছিল আকাশ পথে ভ্রমণকারীদের মনে। তেমনি ২০১৭ সাল আমাদের দেশের বিমান চলাচলের ইতিহাসেও একটি নিরাপদ বছর হিসেবে পার করে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো গত বেশ কয়েক বছর মোটামুটি একটা আস্থার জায়গায় আসতে সক্ষম হয়েছিল। শিডিউল মেনে চলা, যাত্রী পরিসেবার মানবৃদ্ধিসহ সব মিলিয়ে ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু গত সোমবারের এ ঘটনার পর হয়তো একটা বিপরীত প্রভাব আসতে পারে। বিমানযাত্রীসহ সাধারণ মানুষের মনে একটা ভীতিমূলক মনোভাব কাজ করতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটা সাময়িক স্থবিরতা কাজ করতে পারে। এর সুদূরপ্রসারী কোনো প্রভাব হয়তো থাকবে না। মানুষের আস্থা ঠিক রাখার জন্য সরকার ও বিমান সংস্থাগুলো সংকটময় সময়গুলোয় ঠিকমতো তথা যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। বিপদ-আপদ থাকবেই, কিন্তু মানুষ দেখতে চায় বিপদে তারা কী রকম সাহায্য বা রেসপন্স পাচ্ছেন।

সোমবারের বিমান দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের যথাযথ চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো ভালোভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় ইতোমধ্যে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হাসপাতালে আহতদের দেখেছেন। নিহত ও আহতদের স্বজনদের ইতোমধ্যে নেপালে নেওয়া হয়েছে। এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও বিমান সংস্থাকে নিহতদের লাশ ফিরিয়ে এনে তাদের স্বজনদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। নিয়মানুযায়ী প্রত্যেকের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, নেপালে পোড়া রোগীদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা নেই। যদি না থাকে তাহলে আহত বাংলাদেশিদের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরিয়ে এনে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মারাত্মক আহতদের আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের উন্নত হাসপাতালগুলোয় পাঠানো যেতে পারে। স্বজন হারানোদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যথাযথ সেবা নিশ্চিত করে, সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কবি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist