দ্যুতিময় বুলবুল

  ১৭ মার্চ, ২০১৮

সিরিয়া

রক্তাক্ত প্রান্তরে শিশুদের আর্তনাদ

সিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে। সেই বিদ্রোহ এখন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। বিশ্ব শক্তিগুলো সেখানে আজ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতেছে। ফলে উলুখাগড়ার মতো নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। অসহায় শিশুদের আর্তনাদে প্রকম্পিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস। আর বিশ্ব মানবতার বাণী ও প্রেম বেদনার অশ্রু সাগরে নীলকণ্ঠ।

মধ্যপ্রাচ্যের একসময়ের সমৃদ্ধ রাষ্ট্র সিরিয়া। এখন রক্তাক্ত প্রান্তর। দেশটিতে গুলি, বোমা, রক্ত, হাসপাতাল, ক্ষুধা আর হাহাকারÑ এসব নিত্যদিনের শব্দসম্ভার। দেশটির লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী। পথে নেমেছে পথের ঠিকানায়।

সিরিয়ার এই করুণ পরিস্থিতির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দেশটির শিশুদের ওপর। যুদ্ধাবস্থার কারণে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সে দেশের শিশুরা, বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন, আচরণ। তীব্র মানসিক চাপে (টক্সিক স্ট্রেস) ভুগছে তারা। দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানের ২০১৭ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহের রিপোর্ট, ২০১৬ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় শিশুসহ অন্তত ৪৫০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় এই প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে স্থানীয় শিশুদের মানসিক চাপের বিষয়টি উঠে এসেছে। আর এর প্রভাবে তাদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন আসছে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সিরিয়ায় অনেক শিশুই তীব্র মানসিক ভীতি ও সংকটে ভুগছে। বিছানায় প্রসাব করা, নিজের ও বিভিন্ন জিনিসপত্রের ক্ষতি করাÑএমনকি আত্মঘাতী কর্মকা- ও আত্মহত্যার প্রবণতাও সেখানে বেড়েছে ব্যাপক। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় সব শিশু ও ৮৪ শতাংশ মানুষের মতে, যুদ্ধ ও বোমা হামলার ফলেই শিশুদের মানসিক চাপ বেড়ে গেছে। দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই যুদ্ধের কারণে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তাদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে, স্বজনরা হতাহত হচ্ছে। এসব রক্তাক্ত ঘটনা শিশুদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাক্ষাৎকারে ৭১ শতাংশ সিরীয় বলেছেন, যুদ্ধের কারণে শিশুদের মনে ভীতির জন্ম হচ্ছে। আর এই ভীতির কারণেই তাদের বিছানায় প্রসাব করার প্রবণতা বেড়েছে। ৪৮ শতাংশ অভিভাবকের মতে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে স্থানীয় শিশুদের অনেকেই কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে তোতলামির প্রবণতা দেখা দিয়েছে। অনেকে কথা বলা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রায়ই তাদের চুপচাপ ও বিমর্ষ বসে থাকতে দেখা যায়। কারো সঙ্গে মিশতে তাদের ভীষণ অনীহা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আলেকজান্দ্রা চেন বলেন, ‘প্রচ- মানসিক চাপ শিশুদের মস্তিষ্ক ও শরীরের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। বয়স বাড়লে এসব শিশুরা মাদকাসক্তি ও মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে পারে।’

সিরিয়ার সাবেক স্কুলশিক্ষক হিশাম (ছদ্মনাম)। স্ত্রী, পাঁচ সন্তানসহ তিনি স্থানীয় দেইল আল-জউর শহরে থাকতেন। যুদ্ধের কারণে তিনি পরিবারসহ আল-হোল শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে বোমার শব্দ শুনে শিশুরা আনন্দ পেত। এটা তাদের কাছে খেলা মনে হতো। কিন্তু যখন তারা ধীরে ধীরে স্বজন হারাতে শুরু করল, তখন পরিস্থিতি দেখে ভীত হয়ে পড়ল।

‘এখন স্থানীয় শিশুরা সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো কাজ নেই, নেই পড়াশোনার ব্যবস্থাও। আমার বড় ছেলের বয়স নয় হলেও, সে সংখ্যা গুনতে পারে না। সাধারণ যোগ-বিয়োগ করাও তার পক্ষে অসম্ভব।’

সেভ দ্য চিলড্রেনের জ্যেষ্ঠ মানসিক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মার্সিয়া ব্রফির মতে, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের মানসিক ক্ষতি স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এ ট্রমা সিরিয়ার শিশুদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়াতে হবে। সংস্থাটির মতে, দ্রুতই মানসিক চাপে আক্রান্ত সিরিয়ান শিশুদের পাশে না দাঁড়ালে, তাদের সহায়তা না দিলে, বড় আকারের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে দেশটির পুরো একটি প্রজন্ম ভিন্ন রকমের মনোভাব ও তীব্র ভীতি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, যা তাদের পরবর্তী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এদিকে ২০১৭ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের রিপোর্টে বিবিসি ও আলজাজিরা জানায়, ইউনিসেফের প্রতিবেদনে ২০১৬ সালকে সিরিয়ার শিশুদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ২০১১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০১৬ সালেই সবচেয়ে বেশি শিশুর জীবনহানি ঘটেছে। ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ সোমবার সিরিয়ার শিশুদের পরিস্থিতি নিয়ে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউনিসেফ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় বিভিন্ন হামলার মুখে ২০১৬ সালে অন্তত ৬৫২টি শিশু নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের জন্য দেশটির স্কুলগুলোও আর নিরাপদ নয়। কারণ, নিহত শিশুদের মধ্যে ২৫৫টি নিহত হয়েছে স্কুলের ভেতর কিংবা তার আশপাশের এলাকায়। প্রকৃত হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করে ইউনিসেফ। কেননা নিহতের সব তথ্য সব সময় জানা যায় না। লিপিবদ্ধ করাও সম্ভব হয় না। সংস্থাটির মতে, সিরিয়ায় ২০১৬ সালে ৮৫০টির বেশি শিশুকে যুদ্ধ করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যুদ্ধে নিয়োজিত এসব শিশুর অনেককেই সম্মুখযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া তাদের দিয়ে শিরñেদকারী, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী এবং কারারক্ষী হিসেবেও কাজে লাগানো হয়েছে।

ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক গ্রিট ক্যাপেলায়ের বলেছেন, ‘সিরিয়ার শিশুদের ভোগান্তি দুর্বিষহ। প্রতিদিনই দেশটিতে অসংখ্য শিশু হামলার শিকার হচ্ছে। তাদের জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে।’ তার মতে, যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় অন্তত ৬০ লাখ শিশু মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ২৩ লাখ শিশু ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার শিশু দেশটির যুদ্ধকবলিত বিভিন্ন শহরে অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছে। তাদের উদ্ধার করে আনার প্রক্রিয়াটি বেশ কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত ৩ লাখ লোক মারা গেছেন। স্থানীয় অন্তত ৩০ লাখ শিশু জন্মের পর থেকেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠছে।

এদিকে সম্প্রতি সর্বশেষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, যুদ্ধভূমি সিরিয়ায় ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দ্বিগুণ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আট বছর ধরে রোজ চরম ঝুঁকির মধ্যে বাঁচতে হচ্ছে শিশুদের। এক বিবৃতিতে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফের এই উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়ে সিরিয়ার অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস দাবি করেছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জঙ্গি অধ্যুষিত সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতায় সিরিয়া সরকার ও যৌথবাহিনীর বোমাবর্ষণে অন্তত ২০০ শিশু নিহত হয়েছে। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, হামলায় প্রতি পাঁচজন সিরীয় নাগরিকের মধ্যে একটি করে শিশু নিহত হয়েছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শুরু থেকে এ পর্যন্ত সিরিয়ায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছে বলেও জানিয়েছে ওই সংগঠন। ব্রিটিশ সংগঠনটির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় মোট ৩,৫৩,৩৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরো কত মৃত্যু দেখতে হবে সেই অপেক্ষায় অবাক তাকিয়ে আছে পৃথিবী !

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist