এস এম মুকুল

  ১৬ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

চলে গেলেন ব্ল্যাকহোলের আবিষ্কর্তা

বয়স যখন ২১ তখন তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। ওইসময় মোটর নিউরন ডিজিজ (লু গেরিগ ডিজিজ) ধরা পড়লে ডাক্তাররা ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, তিনি আর মাত্র দুই বছর সুন্দর এই পৃথিবীতে আছেন। এই দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে অকালে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য করবে। কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অসাধারণ মেধা ও পরিশ্রমের কাছে হার মানে পঙ্গুত্ব। ডাক্তারদের ভবিষ্যতবাণীকে ভুল প্রমাণ করে তিনি আরো ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু চিরায়ত নিয়মের কাছে অবশেষে তাকে যেন হার মানতেই হলো। বিধির বিধান মেনেই মৃত্যুও অবধারিত স্বাদ গ্রহণ করলেন স্টিফেন হকিং। বিজ্ঞান বিস্ময়ের জগতে পৃথিবীতে যে কয়েকজন মহাজ্ঞানী ও সৃষ্টির অনুসন্ধানী মানুষ ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন। ২০১৮ সালের শুরুর পরবর্তী ক্ষণ থেকেই বলতে হচ্ছে, বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আর নেই। মৃত্যুপরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করেছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তিনি পরকালককে রীতিমতো রূপকথা বলেই মনে করতেন। স্টিফেন হকিং বলেছেন, পরকাল বলে কিছু নেই। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ‘পরকাল’ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পরে আর কোনো জীবন নেই। স্বর্গ ও নরক মানুষের অলীক কল্পনা মাত্র’। এর আগেও গত বছর তিনি ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব ও মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা’ নিয়ে তার বই ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইনে’ অনেক ঔদ্ধত্যপূর্ণ কটাক্ষ করেন। সেখানে তিনি দাবি করেন যে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য ঈশ্বর ধারণার কোন প্রয়োজন নেই। এমন ধারণা পোষণ করেই নিজের পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরের বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। কিন্তু সেই তিনিই আজ সত্যি পরলোকে চলে গেছেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপারটি হলো, চিকিৎসকদের ভবিষ্যতবাণীকে ভুল প্রমাণ করে তিনি আরো ৫৩ বছর বেঁচে ছিলেন। গত বুধবার ৭৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

আইনস্টাইনের পর তাকেই বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী পদার্থবিদ বিবেচনা করা হয়। স্টিফেন হকিং পরপার মানুন আর নাই মানুন, এখন তিনি পরপারে। তথাপি তিনি পৃথিবীতে রেখে গেছেন অনন্য আলোকরেখা। পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ব নিয়ে অন্তহীন গবেষণার পথিকৃত হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন কালের ইতিহাসে। তিনি পৃথিবীর সেরা মহাকাশবিজ্ঞানীদের একজন। তার লেখা ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর ও আপেক্ষিকতা নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ছিলেন ব্রিটিশ এই পদার্থবিদ। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদবাণীতে মিথ্যে প্রমাণ করে বেঁচে গেলেও তার কথা বলা আর চলাফেরার ক্ষমতা কেড়ে নেয় মোটর নিউরন ব্যাধি। শারিরীক অক্ষমতা হলে কি হবে, তিনি থামেননি। প্রভু যেন তাকে উদার হস্তে ঢেলে দিয়েছেন মেধার সমুদ্দুর। যেহেতু হকিং কথা বলতে ও নড়াচড়া করতে পারতেন না, তাই তিনি কথা বলেন ভয়েস সিনথেসাইজারের মাধ্যমে। তার মুখের পেশির নড়াচড়ার অনুযায়ী কথা বলে যন্ত্র। এ ছাড়া গলার কম্পাঙ্ক ও চোখের পাতার নড়াচড়ার মাধ্যমে তিনি কম্পিউটারে লিখতে পারেন বা ভয়েস জেনারেট করতে পারেন। ২০১৩ সালের করা এক প্রামাণ্যচিত্রে স্টিফেন হকিং বলেন- ‘চিকিৎসকরা ভেবেছিলেন, আমি মারা যাচ্ছি, তাই তারা লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রটি খুলে দিতে বলেন জেনকে (স্টিফেন হকিংয়ের প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইল্ড)। কিন্তু জেন তাদের কথায় পাত্তা দেয়নি। সে যন্ত্রটি খুলতে নিষেধ করে। জোর দিয়ে বলে, আমি ক্যামব্রিজে ফিরে যাব। এর পরের নিবিড় পরিচর্যার সপ্তাহগুলো আমার জীবনের অন্ধকার সময়’। প্রতিবন্ধীদের জন্যও এই পদার্থবিদ এক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ২০১২ সালের লন্ডন প্যারা অলিম্পিকেও স্টিফেন হকিং কথা বলেন। তার এই প্রতিবন্ধিতা তাকে জীবনের নতুন এক লক্ষ্যের সন্ধান দেয় বলেও জানান তিনি। প্রামাণ্যচিত্রে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারে। তাই আমি প্রতি মিনিটকে কাজে লাগাতে চাই।’ ১৯৮৮ সালে তিনি লেখেন ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। সারা বিশ্বে বইটির এক কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়। ১৯৮৮ সালে ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে ওঠেন হকিং। বইটিতে তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে তত্ত্ব দেন। মহাবিশ্ব নিয়ে প্রকাশিত তার আরেকটি বই ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’। ১৯৯১ সালে এই বই অবলম্বন করে পরিচালক ইরল মরিসন একটি জীবনীমূলক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যাতে স্টিফেন হকিং নিজেই অভিনয় করেন। বিশ্বের ৩৫টি ভাষায় বইটি অনুবাদ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষাতেও বইটির অনুবাদ রয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। সকল অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতাকে জয় করার ক্ষেত্রে পৃথিবীবাসী নিশ্চয়ই গর্ব করে তার নাম জপবে অনন্তকাল।

লুসি, রবার্ট ও টিম নামে স্টিফেন হকিংয়ের তিন সন্তান। হকিংয়ের বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং ছিলেন জীববিজ্ঞানের গবেষক। মা ইসাবেল হকিং ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। বাবা চেয়েছিলেন, হকিং বড় হয়ে চিকিৎসক হোক। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হকিংয়ের আগ্রহ বিজ্ঞান আর গণিতে। মহাবিশ্বের অজানা বিষয়গুলো নিয়ে উৎসুক ছিলেন হকিং। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ‘বিগ ব্যাং থিওরি’র প্রবক্তা বলা হয় স্টিফেন হকিংকে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক পদ থেকে ২০০৯ সালে অবসর নেন। রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। তার জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে, ৮ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। হকিংয়ের প্রতিভা এবং রসবোধ বিশ্বব্যাপী মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মানবজাতির অস্তিত্ব সম্পর্কে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা যান্ত্রিক বুদ্ধির যতই অগ্রগতি ঘটবে মানুষের অবসান ততই কাছে এগিয়ে আসবে। মানুষের অগ্রগতির বিবর্তন ধীর। ফলে এরা (যন্ত্রের সঙ্গে) প্রতিযোগিতায় আর টিকে থাকতে পারবে না। এক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়বে।

স্টিফেন হকিংয়ের যখন নয় বছর বয়স তখন তিনি ছিলেন ক্লাসের সর্বশেষ মেধাক্রমের ছাত্র অর্থাৎ পেছনের দিক থেকে প্রথম। যদিও পরীক্ষায় কম পেতেন তবুও তার বুদ্ধির তীব্রতায় শিক্ষকদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। বিজ্ঞান সর্ম্পকে আগ্রহের কারণে শিক্ষক আর বন্ধুরা আদর করে ডাকতেন আইনস্টাইন। আত্মজীবনী লেখক ক্রিস্টিন লার্সেন এর ভাষ্যমতে স্টিফেন হকিং ভার্সিটি জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন অনেক বেশি নিঃসঙ্গ। তাই হয়তো একাকিত্ব দূর করতেই যোগ দিয়েছিলেন কলেজের বোট রেসিং টিমে। সবচেয়ে মজার কথা হলো তার দায়িত্ব ছিল রেসের সময় নৌকার হাল ধরে রাখা। গ্রাজুয়েশন শেষ করে ক্রিসমাসের ছুটিতে বাড়ি আসতেই তার পরিবারের সদস্যরা তার অসুস্থতার বিষয়টি খেয়াল করেন।

১৯৮৩ সালে জিম হার্টলের সঙ্গে আবিষ্কার করেন মহাবিশ্বের আকার আকৃতি সর্ম্পকে অজানা তথ্য। প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদকসহ এক ডজনেরও বেশি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ২০০৭ সালে স্টিফেন হকিং তার মেয়ে লুসি হকিংয়ের সঙ্গে মিলে লিখেছিলেন ছোটদের বই ‘এবড়ৎমব’ং ংবপৎবঃ কবু ঃড় ঃযব টহরাবৎংব’ যা জর্জ নামের ছোটো বালকের কাহিনি কিন্তু যাতে রয়েছে ব্ল্যাকহোলসহ নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা। ধারণা করা হয়, ষোলো শতাব্দীর ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডামুসের চেয়ে বিশ শতাব্দীর বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর দাম বেশি। নস্ট্রাডামুসের নামে বহুবার ‘কেয়ামত’-এর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবে ‘সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’-এর লেখক হকিং যখন বলেন, ‘বাঁচতে হলে মানুষকে ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী ছাড়তে হবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে তিনি বলেন- পৃথিবীর বেশি সময় নেই। বড়জোর এক হাজার বছর পৃথিবী টিকে থাকবে। জলবায়ুর পরিবর্তন, পারমাণবিক বোমা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে এই মন্তব্য করেন। বিষয়গুলোকে সামনে এনে নতুন কোনো বাসস্থান খোঁজার জন্যও তাগাদা দিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। আফফোস, আজ তিনি নিজেই চলে গেলে সৃষ্টিরহস্যের ধুম্রজাল ছিন্ন করে।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist