ইয়াসমীন রীমা
মতামত
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ
বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কী করে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কত দূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহা।’ ঊনবিংশ শতাব্দীর এই বক্তব্য আজো আমদের ভাবিয়া তোলে। এই বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য নারীর ক্ষমতায়ন যা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। সম্মুখ সমরে নারীর অংশগ্রহণ অল্প হলেও, অন্যান্য ভূমিকা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কোনো কিছুর বিনিময়ে পরিশোধযোগ্য নয়। প্রতিটি ঘরে ঘরে মায়েরা নির্ভয় নিঃশব্দ চিত্তে তাদের অতি আদরের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উৎসাহিত করেছেন। এ ছাড়া আশ্রয়দান, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা, খাদ্য সরবরাহ, খবর আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক চেতনায় উৎসাহ প্রদান, অর্থ সংগ্রহসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপামর বাঙালি নারীরা নিরন্তরভাবে করে গেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারীদের এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় নাই। অধিকন্তু আমরা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ধারায় দেখতে পাই, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। ২৮(১) ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ ও নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রবৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের কথা আমাদের সংবিধানের ১০,১৯(১)-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তুু বাস্তবতা হচ্ছে নারী তুলনামূলক বিচারে পূরুষের চেয়ে অনগ্রসর, পিছিয়েপড়া ও সুবিধাবঞ্চিত। পুরুষতান্ত্রিকতার ধারাবাহিকতায় নারী এখনো অধঃস্তন। নারী-পুরুষের এই বৈষম্যের কারণে আমাদের সমাজের রীতিনীতি, দৈনন্দিন আচার, মূল্যবোধ ও কর্মসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে নারী এখনো তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; হচ্ছে উপেক্ষিত।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নারী বর্ষ’ ঘোষিত হয় এবং ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি প্রথমবারের মতো ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে দেশের বাইরে নারী উন্নয়নের আন্দোলনের মূল ধারায় বাংলাদেশ যুক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সালকে ‘নারী দশক’ হিসেবে ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নারী অধিকারের বিষয়গুলো উন্নয়নের কেদ্রবিন্দুতে চলে আসে। নারী দশকের লক্ষ্য ছিল সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। ওই কর্মপরিকল্পনায় নারী উন্নয়নের ১২টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। সব আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। রাষ্ট্র, অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালের জাতিসংঘে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) ঘোষিত হয়। সেই সিডও সনদ ও এমডিজির মতো আন্তর্জাতিক সনদগুলো পালনে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৮ মার্চ ১৯৯৭ সালে ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা পুনর্বহাল করেন। এই নীতিমালা বাংলার বঞ্চিত নারী সমাজের মুক্তি সনদ। এটি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন।
নারী উন্নয়ন একটি ব্যাপক কাজ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেসরকারি সংগঠনগুলো গ্রামগঞ্জে নারীর ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সিডও বাস্তবায়ন ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কারণ একজন নারী আগে একজন মানুষ, আর তাই নারীর প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি ও ক্ষমতায়ন। এই বিষয়টি এখন গ্রাম থেকে গ্রামে বিস্তৃত করা সম্ভব হয়েছে। হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও নারী এগিয়ে চলেছে। ক্ষমতায়নের মূল শর্ত হচ্ছে জ্ঞান, আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করা।
স্কুল, কলেজ, সরকারি চাকরি (পুলিশ ও Defence-সহ) মিডিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি সব জায়গায় আমরা নারীদের সদর্প বিচরণ দেখতে পাই, তবে তা সীমিত। আমাদের আরো একটি অর্জন ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন; জনগণের সরাসরি ভোটে তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন নারী-সদস্য নির্বাচিত হওয়া। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে নারী উন্নয়নের জন্য নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে স্থানীয় ও সরকারি পর্যায়ে সমন্বয় করে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য এখনো নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ হয়নি। ১. নারীর প্রতি গতানুগতিক ধারণা ও পিতৃতান্ত্রিকতা মনোভাব। ২. নারীর কাজকে মূল্যায়ন না করা। ৩. বাংলাদেশের নারীরা এখনো সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। ৪. বাংলাদেশে যতগুলো আইন আছে, বিশ্বের কোথাও নারী নির্যাতনের এতগুলো আইন নাই। কিন্তু দঃখের বিষয়, এই আইনগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া। ৫. নারীদের কর্মক্ষেত্রে উপযোগী পরিবেশে না থাকা। ৬. নারী-পুরুষের বৈষম্য বিদ্যমান থাকা। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের যা করা প্রয়োজন তা হলোÑ১. রাষ্ট্রীয় বাজেটে নারী উন্নয়নের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা। ২. আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিরাপত্তা ও আস্থা অর্জনের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ। ৩. নারীর প্রতি আইনগত সম-অধিকার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। ৪. ধর্ম, বর্ণ, পেশা শ্রেণি নির্বিশেষে নারীসমাজের প্রতি বৈষম্য দূর করে অধিকার সংরক্ষণ। ৫. কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ও উপযোগী পরিবেশ। ৬. সব ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ। ৭. One stop Service ও Shelter Home তৈরি এবং আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা আর নারীদের অবলা মানতে রাজি নই। তবু এ কথা সত্যি, প্রকৃতপক্ষে অবলান্তের গ-ি এখনো অতিক্রম করতে পারিনি। এক কথায়, হাজার হাজার সংস্কারের আবর্জনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ঘিরে রেখেছে, তাকেই দূর করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের সর্বাগ্রে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি যদিও দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা রয়ে গেছে পুরুষের হাতেই। নারীকে ক্ষমতা প্রয়োগ করার যথেষ্ট সুযোগ, সুবিধা, সামাজিক প্রেক্ষাপট বা সম্মান কোনোটাই দেওয়া হয়নি। দেশের সর্বস্তরে নারীদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতিষ্ঠা পাওয়াকে আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এখনই সময়Ñআর দেরি না করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী-পুরুষ সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে এনে আমাদের সন্তানদের সামনে সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে। কে জানে হয়তো অদূরেই আরো বহু পথ মিলে এক দিন এ পথই প্রশস্ত রাজপথে পরিণত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"