এস আর শানু খান
মতামত
হীনম্মন্যতা এবং...
নিজেকে নিজে বড় ভাবা মানুষের অভাব নাই। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা নিজেকে ছাড়া অন্য সবাইকে ছোট বলে ভাবতে ভালোবাসেন। কোনোভাবে তারা বুঝতেই চান না যে বড়দের সম্মান ও ছোটদের আদর করার মধ্যে কতটা আনন্দ আর সুফল লুকিয়ে আছে। তারা মনে করেন, আমরা যা বুঝি বা আমি যা করছি সেটাই ঠিক। এখানে কোনো ভুল নেই। এরা আসলে হীনম্মন্য এবং অসুস্থ। আর এই হীনম্মন্যতার কারণেই তারা সমাজে সাময়িকভাবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারলেও সময়ের পরিক্রমায় ওরা বিস্তৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যান। এ রকম হীনম্মন্যতার কারণেই জ্ঞানী, বিদ্বান ব্যক্তিদের সদুপদেশ, সৎপরামর্শ ও সৎবুদ্ধিকে এরা উপহাস করতেও কার্পণ্য করেন না। মানুষ মাত্রই নানা ভুলের মধ্যে বসবাস করে। শুদ্ধকে খুঁজে নিতে হয়। জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে প্রতিনিয়তই মানুষ নানা ধরনের ভুল করে। কিন্তু এই হীনম্মন্য মানুষরা ভুল করতে পারেন বা তাদের দ্বারা যেকোনো ভুল হতে পারেÑএটাই তারা সহজে মেনে নিতে পারেন না।
সামাজিকভাবে এরা ভ- ও হীন প্রবৃত্তির মানুষ। মানুষের দুর্বলতা নিয়ে মজা করাতেই এদের আনন্দ। মানুষকে ছোট করে তারা যে আনন্দ পান, তাকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় পৈশাচিকও বলা যেতে পারে। এই হীন প্রবৃত্তির মানুষরা স্বভাবত স্বার্থপর, অহঙ্কারী ও সংকীর্ণমনা হয়ে থাকেন। সমাজের কোনো মানুষ সাহায্যের জন্য এদের কাছে এলে ওরা আত্মতৃপ্তিীত ভোগেন। এদের চিন্তা-চেতনা সব সময় আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমগ্ন থাকে। মানুষের কোনো কিছুতেই এরা মূল্য দিতে নারাজ। সব সময় নিজেদের নাম-গন্ধ ছড়ানোর নেশায় মত্ত থাকেন, যোগ্যতা থাক আর নাই থাকুক। নিজের ছেলে, নিজের মেয়ে, নিজের পরিবার, নিজের আত্মীয়স্বজন সবার মধ্যে নানা গুণাগুণ দেখতে পারলেও অন্যের বেলায় তার বিপরীত। আমাদের এলাকার এক ছোট ভাই এসএসসি ও এইচএসসিতে গোন্ডেন প্লাস। বাবা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। একই সঙ্গে ওই স্কুলের আরো একজনার এক ছোট ভাই এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন প্লাস। এর বাবা ওই স্কুলেরই শিক্ষক। ভ্যানচালক বাবার ছেলে সকাল-বিকাল মানুষের গাছের সুপারি, নারকেল পেড়ে টাকা ইনকাম করে খাতা-কলম কিনতেন। অসাধারণ মেধাবী এই ছেলে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। আর শিক্ষকের সন্তান চান্স পায় সরকারি মেডিক্যালে। দুজনেই মেধাবী। কিন্তু স্কুলশিক্ষক কিছুতেই ভ্যানচালকের সন্তানকে শিক্ষক হয়েও ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করতে পারেননি।
এই সংকীর্ণমনা মানুষরা জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জন করলেও অহঙ্কারী মনোবৃত্তির কারণে সমাজে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সম্মানের পরিবর্তে তাদের ডিপোজিটে জমা হয় সামাজিক ঘৃণা। কেউ যদি কখনো ভালো উপদেশও দেন, সেগুলোকে মেনে নিতে তাদের কষ্ট হয়। নিজেকে ছাড়া অন্য সবাইকে তারা ছোট মনে করার কারণে এরা এক ধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষে পরিণত হয়ে থাকেন। অন্য কেউ যে তার বা তাদের চেয়ে বেশি জানতে পারেন, এই প্রবৃত্তির মানুষ সেটা মানতে রাজি নন।
এরা যেমন কখনোই কাউকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে জানেন না, একইভাবে এরাও কারো কাছে সম্মান বা মূল্যায়ন পান না। মিথ্যা অহঙ্কার ও আত্মগরিমার জন্য বিপদ ও বিপর্যয় সব সময় এদের ছায়ার মতো অনুসরণ করে। নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও দৃষ্টির সংকীর্ণতাই তাদের মোহান্ধ করে রাখে। এ ধরনের আচরণ কখনোই সমাজের কোনো মঙ্ঘল বয়ে আনে না। তাই তো আমাদের উচিত কোনো মানুষকেই ছোট করে না দেখা, যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ততটুকুই সমাদর করা। অন্যথায় সমাজও তাকে ঘৃণা ছুড়ে দিতে বাধ্য হবে এবং এটাই বিজ্ঞান (নিউটনের তৃতীয় সূত্র)।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"