সফিউল্লাহ আনসারী

  ০৯ মার্চ, ২০১৮

নারী দিবস

জয় হোক মানবতার

‘বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ জাতীয় কবির উপলব্ধি মিথ্যে হওয়ার নয়, চির সত্য। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে মৌখিক অধীকারপ্রাপ্ত নারী তার সম্পূর্ণ অধীকার সমনভাবে পায়নি। মানুষের চিন্তা, চেতনা আর মানসিকতার পরিবর্তন সঠিকভাবে কাজ না করা এর পেছনে অনেকটা দায়ী। বিশ্বে নারী নেতৃত্ব আজ স্বীকৃত এমনকি কোনো বিভেদ ছাড়াই নারী তার সমান অধীকার ভোগ করে চলেছে।

International Women’s Day (IWD)) বা আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে এ দিবসটি। অবশ্য এর আগে এই দিবসটি ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। আর অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস।

এই দিবসটি উদ্যাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন।

‘১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা।

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে।’ (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

নারী দিবস মূলত নারী সমাজের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়সহ সর্বক্ষেত্রে তাদের অধীকার, সুযোগ এবং ক্ষমতায়নে পুরুষের সমান অবস্থানকে সমুন্নত রাখার আন্দোলন। বিশেষ করে পৃথিবীর নারীদের অধিকার কতটুকু অর্জিত হয়েছে এবং নারীরা কীভাবে, কী কী বৈষম্য ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, তা মূল্যায়ন করা ও তুলে ধরে তা থেকে উত্তরণের চেষ্ঠায় কাজ করা। বিশ্বের কোথাও নারীর অধিকার নিয়ে, কোথাও নারীর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে, কোথাও নারীর কর্মের স্বাধীনতা নিয়ে, আবার কোথাও নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে ভিন্ন আয়োজনে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। তবে সব ক্ষেত্রে নারী অধীকারকে গুরুত্ব দেয়া হয় সম-অধীকারের জন্যই।

‘বাংলাদেশে আর্ন্তজাতিক নারী দিবসটি পালিত হওয়ার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমাদের সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যকে গুডবাই জানিয়েছেন আধুনিক নারী সমাজ । সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌন নির্যাতন, নারী পাচার, হত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতনের কবল থেকে আজও নারীদের মুক্তি পুরোপুরি সম্ভব না হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় চিন্তার পরিবর্তন ঘটছে, যার সুফল নারী সমাজ ভোগ করছেন। নারী আন্দোলন, সংগ্রামের ফলে বিশ্বের নারী সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করছে। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাতেও বলা হয়েছে, সব মানুষ সমভাবে জন্মগ্রহণ করে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক অধিকার, ভোট প্রদানের অধিকার ও দফতরে কাজ করার অধিকার রয়েছে।

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর সুরক্ষায় রয়েছে আইন। নারী শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সারা বছর নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও নারী নির্যাতন রোধে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও সীমাহীন দুর্ভোগ কেবল নারীর ভাগ্যেই জুটে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের মতো অহরহ জঘন্য ঘটনা। আমাদের সমাজ যৌতুক প্রথা থেকে আজও বের হয়ে

আসতে পারেনি। বাল্য বিয়ে ও চাকরির নামে আজও নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আজও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের

শিকারও নারীই। পরিবার ব্যাবস্থায় নারীকে আজও অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়।নারী শিক্ষার হার বাড়লেও পারিবারিক ও সামাজিক কুসংস্কার ও মেয়ে শিশুকে গুরুত্ব না দেওয়ায় নারীর অবস্থান আশানুরুপ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। তবে দিনকে দিন সংকীর্ণ ধারণা পাল্টাচ্ছে, নারী তার চেষ্ঠায়, কর্মে এগিয়ে যাচ্ছেন আপন মহিমায়।

বিশ্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি বর্বরতার শিকার নারী ও শিশুরা। কারণ, নারীরা সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে; ঘরে-বাইরে ও শ্রমজীবি নারী কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নেও রয়েছে বৈষম্য। বিশ্বায়নের জাগরণ ও আধুনিকায়নের এ যুগে একজন নারীর ক্রীতদাসের জীবন নিয়ে আমরা কোন ক্ষেত্রেই শতভাগ সফলতা কামনা করতে পারিনা। কারণ একজন নারী একজন মানুষও। তাই মানুষের অধীকার শুধু নারী-পুরুষে ভাগ করার কিছু নেই। পুুরুষ-নারীর সম-অধীকার বর্তমান সময়ের অনিবার্য দাবি।

একজন নারী-মা, বোন, স্ত্রী, সহকর্মী। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পীকার নারী, বিরোধী দলের নেত্রী ও বড় দলের প্রধানও নারী। অর্থনীতির চাকা সচল রেখে নারী গার্মেন্টস কর্মীরা তাদের শ্রম দিয়ে মেধা দিয়ে প্রতিনিয়িত কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও নারী সমাজের প্রতি বৈষম্যের সাথেই দুর্গতি লেগেই আছে। আমাদের পারিবারিক মানসিকতার পরিবর্তন, সামাজিক আন্দোলন, নারী স্বাধীনতার বাধা দূর করা, বিশেষ করে চিন্তা-চেতনায় বৈষম্য ও হিনমন্যতাকে বিদায় করে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে নারী-পুরুষ সমান ভেবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। নারীর প্রতি সামাজিক আচরণ ও ছোট করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর এ অন্তরায় দুর করতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতন করতে হবে । জাগতে হবে, জাগাতে হবে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ নীতি- দুর্নীতির পার্থক্যকে অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে সময় লাগে, ভুল করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান, মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে আমাদের নারী আন্দোলনকারীদের নতুন করে ভাবতে হয়। সেই ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে, নারী অধীকারে সোচ্চার হই, একজন নারীকে শুধু ভালো বউ, ভালো মেয়ে হিসেবে না চেয়ে, হই নারীর সহযোদ্ধা-কর্মে-কাজে ও মানবিকতায়। আর্ন্তজাতিক নারী দিবস শুধু একটি দিনে নয়, সারা বছর জুড়ে আমাদের সচেতনতাকে বাড়িয়ে নারীর প্রতি সম-অধীকার মনো ভাবাপন্ন করে তুলুক। জয় হোক নারী সমাজের, জয় হোক মানবতার।

লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist