রেজাউল করিম খান

  ০৮ মার্চ, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নারী দিবসে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রভৃতি নানা দিবস পালিত হয়। কিন্তু দিবসগুলো কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও বাক-সর্বস্ব। এই উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দেবেন। এনজিও ও নারী সংগঠনগুলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন করবে, সমাবেশ হবে, শোভাযাত্রা বের করবে। সেমিনার, আলোচনা সভা হবে। বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে। নারীনেত্রী ও অতিথিরা অনুষ্ঠানে হাজির হবেন। অন্যদিকে কিছু নেতানেত্রী কতিপয় কর্মী নিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন হাতে প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়াবেন। তাদের উপস্থিতি খুব বেশি হবে না। এর অর্থ এই নয়, বাংলাদেশের নরীরা নারীমুক্তির আন্দোলন করে না বা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজপথে নামে না। এমনই বাস্তবতায় এবারও সারা দুনিয়ায় পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এবারের প্রতিবাদ্য বিষয়Ñ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরের কর্ম-জীবনধারা’।

সত্যিই কি সময় এখন নারীর? হয়তো! অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। এখানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকারসহ সরকার ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নারীর অবস্থান। তারা কর্তৃত্ব করেন, ভাষণ দেন, হুকুমের সুরে শাসন করেন। কিন্তু নারীর প্রতি সংিসতা কমে না, ধর্ষণ-খুন বন্ধ হয় না, শ্রমজীবী নারীর মজুরি বাড়ে না, বখাটে-মাস্তানের ভয়ে নিরাপত্তার অভাবে বাল্যবিবাহ বাড়তেই থাকে, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে, স্বাভাবিক সুস্থ চিন্তা-চেতনা বিকশিত হয় না, কৈশোরের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখে না, বয়সের আগেই মা হয়ে যায়, অপুষ্টি আর অবসাদ গ্রাস করে। কোনো এক ধূসর সকালে এনজিও সমিতির আপারা এসে দুই পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে সঁপে দেয় ভাগ্যের হাতে। অবশেষে একদিন মৃত্যু এসে পালকের মতো হালকা জীবনটাকে নিমেষেই উড়িয়ে নিয়ে যায়। নারীর মধ্যেও শ্রেণিবিভাগ আছে, আছে বৈষম্য। একজন সাধারণ নারী তার স্বামীর নির্যাতন থেকে মুক্তি চায়, শ্রমজীবী নারী চায় তার শ্রমের ন্যায্য মজুরি। এসব হতদরিদ্র নারী-পুরুষ চায় তাদের বেঁচে থাকার সামান্য উপকরণগুলো সহজলভ্য হোক, আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হোক নতুন প্রজন্মের জন্য। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীর সমস্যা ভিন্ন। তাদের অনেকেই পুরুষকে শাসন করে। রোজগার করে কালোটাকা। ভোগ করে। তাদের আছে অবাধ স্বাধীনতা। সমাজে তাদের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। বিদ্যমান রাষ্ট্র এ ব্যাপারে উদাসীন। উনিশ শতকের প্রথম থেকেই নারীরা নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের গার্মেন্ট শ্রমিকরা শ্রম দিবস আট ঘণ্টা, কথায় কথায় ছাঁটাই, বেতন-ওভারটাইম কাটা, দাঁড়িয়ে কাজ করা প্রভৃতির প্রতিবাদে ধর্মঘট আহ্বান করে। ধর্মঘটী নারীদের ওপর পুলিশের পাশবিক নির্যাতন, গ্রেফতার, জেল ও জরিমানা সত্ত্বেও তারা পিছু হটে না। বরং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও সাহসী শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। এই ঘটনায় মালিক শ্রেণি ও সরকার চিন্তিত ও সতর্ক হয়।

১৯১০ সালে এক সম্মেলনে কমিউনিস্ট নারীনেত্রী ক্লারা সেৎকিন ওই অভ্যুত্থান বার্ষিকীতে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেন। রুশ বিপ্লবের নেতা ভ. ই. লেলিন এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্রে নরীবাদ শব্দটির প্রচলন হয়। নরীবাদ হলো নারী ও পুরুষের মধ্যকার সমতার একটি মতবাদ। নারীবাদ মতাদর্শ হলো নারীরা রাজনৈতিক, সামাজিক লৈঙ্গিক, বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। নারীদের কর্মকা- বৃহৎ পরিসরে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত। আন্দোলনকারীরা নারীর আইনগত অধিকার (চুক্তি, সম্পত্তি, বৈবাহিক ও ভোটাধিকার) দৈহিক স্বাধীনতা ও অখ-তা রক্ষার অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, প্রজনন অধিকার (জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার, সন্তানের সংখ্যা নির্ধারণ ও উন্নতমানের প্রসূতি চিকিৎসা লাভের অধিকার। পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক ও মানসিক হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীবাদ গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেক ভালো সত্ত্বে¡ও বাংলাদেশে নারীবাদীরা আশানুরূপ সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। নানা নির্যাতন নারীমুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। নারী তার ঘরেই বেশি নির্যাতিতা হন। বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক ও ৫৩ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। ‘ভায়োলেন্স এগেইন্স্ট উইমেন সার্ভে-২০১১’ নামের এই জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। নারী আর ধর্ম নিয়ে এই দুনিয়ায় যত লেখা হয়েছে, বোধ করি এত লেখা আর কোনো বিষয় নিয়ে হয়নি। এদের নিয়ে যুদ্ধও হয়েছে বিস্তর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীকে মুক্ত করার লড়াই শুরু হয়েছে সেই ১৮৫৭ সালে। পরে সমাজতন্ত্রীরা অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন এই আন্দোলনকে। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলন দৃশ্যত শৌখিন। সহজেই নারীমুক্তির কথা বলা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক শ্রেণির একাংশই কি ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারী নয়? তাদের রক্ষা ও মদদ দিচ্ছে কে? পুরুষতন্ত্রের রক্ষক সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের বিরোধিতা না করে নারীমুক্তি কি সম্ভব? বাল্যবিবাহ আইন-২০১৭-তে মৌলবাদীদের চাপের মুখে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে বর্তমান সরকার, এর বিরুদ্ধে কারা সোচ্চার হয়েছেন? নারীকে পণ্য বানানোর সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফ্যাশন শো, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, নাটক বন্ধের দাবি কোথায়? সৌদি আরবে গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রতিবাদ হয় না কেন? এর পরও প্রশ্ন থাকে, নারী কী বা কার কাছ থেকে মুক্তি চায়? মুক্তিদাতা কে? নারী কী পরাধীন? বন্দি? কে তাকে বন্দি করে রেখেছে? মুক্ত হয়ে সে কী করবে? এতসব প্রশ্নের জবাব মেলা কঠিন। পুঁজিবাদ অনেক কিছুর মতো নারীকেও পণ্য বানিয়েছে। এরও আগে ধর্ম তাকে বানিয়েছে পুরুষের আনন্দের উপকরণ। প্রায় সব ধর্মগ্রন্থই নির্দেশ দিয়েছে, নারীকে রাখতে হবে ঘরের ভেতর বন্দি। তার কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করা, পুরুষকে আনন্দ দেওয়া আর সন্তান লালন-পালন করাই তার একান্ত কর্তব্য।

আলোচনার এই পর্যায়ে স্বীকার করা অযৌক্তিক হবে না, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমেই হতে পারে নারীমুক্তি। নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টিই প্রধান। একদিনের নারী দিবস পালনের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist