সাবরিনা শুভ্রা

  ০৭ মার্চ, ২০১৮

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, যা নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মীয় এবং আইনগত দিক থেকে অবৈধ এই কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুকের বলি হয়ে দেশে প্রতি বছর অনেক নারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যৌতুকের কারণে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার এক ক্ষুদ্র অংশ আইন-আদালত কিংবা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। দেশে যৌতুকবিরোধী কড়া আইন থাকলেও তার প্রয়োগ যেমন সীমিত, তেমনি এই আইনের অপব্যবহারও কম নয়। পারিবারিক বিরোধে কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্যও যৌতুক আইনের অপব্যবহার করা হয়। যৌতুকবিরোধী আইনে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান থাকা সত্ত্বেও তা যৌতুকলোভীদের সামাল দিতে পারছে না সামাজিক সচেতনতার অভাবে।

ধর্মীয় চেতনার পরিপন্থী এ কুপ্রথার বিরুদ্ধে আলেমসমাজকে সর্বাগ্রে সক্রিয় হতে হবে। যৌতুক বন্ধে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির সুযোগ থাকলেও এ ব্যাপারে এ যাবৎ কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। যৌতুক কেবল গরিবের ঘরে নয় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, ধনী সব ধরনের পরিবারেই ছড়িয়ে আছে অভিশাপ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জন নারীকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯৫ জন নারী। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ১৬ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়েছে ১৮ জনকে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ১৯২টি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর-২(ঞ) ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, (অ) কোনো বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা পূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে কনেপক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ; অথবা (আ) কোনো বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদসমূহকে যৌতুক বলা হবে।

যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, এর ৩ ধারায় যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের দ- সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী এই আইন বলবৎ হওয়ার পর, কোনো ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে অথবা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করলে, সে অনধিক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এবং এক বৎসরের কম নহে মেয়াদের কারাদ-ে বা জরিমানায় কিংবা উভয় দ-ে দ-িত হবে। এ ছাড়া এই আইন কার্যকর হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতা-মাতা বা অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবি করলে, সে অনধিক পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এবং এক বৎসরের কম নহে মেয়াদের কারাদ-ে বা জরিমানায় কিংবা উভয় দ-ে দ-িত হবে।

দেশ ও জাতির স্বার্থে যৌতুকের কারণে নারীনির্যাতনের এই চিত্রের অবসান জরুরি। যৌতুকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন। ইসলামে যেহেতু যৌতুককে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই ইসলামের অনুসারী, সেহেতু মসজিদের ইমাম এবং আলেম-ওলামার মাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে এবং এ বিষয়ে তাদেরও সচেতন হতে হবে। সর্বাগ্রে নিজেকেও সংশোধন করে অপরকে সংশোধন হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলোও যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে পারে ধর্মীয় পুরোহিতরা। পাঠ্যপুস্তকে যৌতুকবিরোধী বিষয় এবং যৌতুক-সংক্রান্ত আইনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মৌলিক নির্দেশনার আলোকে যৌতুক নিষিদ্ধ বিষয় বলে বিভিন্ন কারণে মূল্যায়িত হয়। ইসলাম নারীকে আর্থিক সামর্থ্য দানের লক্ষ্যে এবং তার সম্ভ্রমকে সম্মান জানানোর জন্য ‘মাহর’ নির্ধারিত করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, নারীদের তাদের মোহরানা সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দাও। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মোহরানা নির্ধারণ করল পরিমাণে যাই হোক; কিন্তু মনে মনে তা পরিশোধের ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে কিয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে উঠবে।’ প্রচলিত যৌতুক প্রথার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মোহরের স্থলে উল্টা কন্যাপক্ষকে স্বামীর অবৈধ আবদারের অর্থ ও সম্পদ পরিশোধ করতে হয়। ইসলাম এ অন্যায়কে অনুমোদন করে না। যৌতুক একটি জুলুম। নারীর অভিভাবকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার প্রতি যৌতুকের মাধ্যমে অন্যায় করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সব জুলুমই হারাম’। সে হিসেবে যৌতুকও ধর্মীয় দৃষ্টিতে অবশ্যই হারাম। যৌতুক নারী নির্যাতনের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশে কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যৌতুকলোভী স্বামীদের দ্বারা অসংখ্য নারী নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছেন। অথচ আল্লাহর নির্দেশ, ‘স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে’। যৌতুকের নানা খারাপ দিক রয়েছে। সরকার আইন করেছে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে। এটা এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এ আইন পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। যৌতুকের লেনদেনের কথা লিখিত থাকে না বিধায় প্রমাণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে একটি কথা না বললেই নয়, মানুষ যত দিন ভোগবাদী চিন্তার চূড়ান্ত স্তর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে, তত দিন এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সুতরাং, চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সেই চিকিৎসা হতে হবে মানুষের চিন্তায়। মানবতার কল্যাণে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist