নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

বিশ্লেষণ

কৃষি ও শিল্পে পরিবেশের গুরুত্ব

‘মাটিতে হাত দিয়ে চারা রোপণ করলে লজ্জার কিছু নেই। নিজের হাতে বাগান করলে সেই বাগানে যখন একটা ফল হয়, সেটা ছিঁড়ে খেতে আরো বেশি গর্ববোধ হয়।’ সম্প্রতি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ বিতরণকালে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তার মতে, আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা লেখাপড়া শিখাচ্ছি। কিন্তু লেখাপড়া শেখার পর অনেকে আর জমিতে কাজ করতে চাইছে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের কৃষিকাজে অন্তত আন্তরিক করতে ব্যবহারিক শিক্ষাটার দিকে নজর দিতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে শিল্পে উন্নত হব, কিন্তু কৃষিকে বাদ দিয়ে নয়। কারণ কৃষিই তো আমাদের কাঁচামালের জোগানদাতা। কৃষিই খাদ্যের উৎস।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছর ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ, প্রাণিসম্পদ ও বনায়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য দেশের ৩২ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ১৪২৩ প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তার অভিব্যক্তি হলোÑএখন অনেকেই ছাদে বাগান করছেন। গ্রাম-গঞ্জ পর্যায় পর্যন্ত সবাইকে এই কাজে উৎসাহিত করা উচিত। প্রত্যেকে অন্তত নিজের ঘরেও যদি বাগান করেন বা নিজের যেসব জমি আছে সেখানে বাগান করেন অথবা অব্যবহৃত যেসব জমি পড়ে আছে কো-অপারেটিভের মাধ্যমে সে জমি যদি চাষ করা যায়, তাহলে খাদ্যের অভাব তো হবেই না, উপরন্তু বিশ্বের অনেক দেশের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া যাবে। সেই সক্ষমতা আমাদের অর্জিত হবে।

জার্মানিতে শতকরা ১২ ভাগ ছাদ সবুজ এবং টোকিও আইনে সব নতুন ছাদে অন্তত ২০ ভাগ সবুজ রাখার কথা বলা হয়েছে। শহরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং বিষমুক্ত সবজিপ্রাপ্তিতে ছাদে বাগান তৈরিব জন্য বাধ্যতামূলক করে নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (পবা)। অন্যদিকে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমাতে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন রাজধানীর এমন ১০ জন মালিককে ‘গ্রিন অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সবুজ ঢাকা নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। আমরা এ ঘোষণাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সংগঠনটির মতে, ঢাকা শহরে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেশি। গাছগাছালিও পর্যাপ্ত নেই। এটাই পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। ঢাকায় কীভাবে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়, সেই পরিকল্পনা থেকেই সবাইকে ছাদ-বাগানে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রতি বাড়িতে একটি করে ছাদ-বাগান হলে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে, বায়ু ও শব্দদূষণও কমবে। আয়োজকরা জানান, সবুজ ঢাকার পক্ষ থেকে বিজয়ী মালিকদের সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট প্রদান ছাড়াও তার বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স ১০ শতাংশ মওকুফ এবং বাগান পরিচর্যা বাবদ এক বছরের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়া হবে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। কৃষিকে আমরা যান্ত্রিকীকরণ করছি। এখন হাত দিয়ে চারা রোপণ করা লাগে না। আমরা মেশিন দিয়ে চারা রোপণ করতে পারি। জমি চাষ করতে পারি, ফসল কাটতে পারি, ফসল আলাদা করতে পারিÑসবই করা যায় মেশিন দিয়ে। এতে একদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব দূর হচ্ছে এবং অন্যদিকে উৎপাদন খরচও হ্রাস পাচ্ছে। কৃষির প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট হচ্ছে শিক্ষিত তরুণরা। জানা যায়, কৃষিযন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ৯৫ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে। বালাইনাশকের ব্যবহারে শতকরা ৯০ ভাগ এবং ফসল মাড়াইয়ে শতকরা ৭৫ ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া সার প্রয়োগ যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে শতকরা ৩ ভাগ, চারা রোপণে ১ ভাগ, ফসল কাটা ১ ভাগ, এগুলো বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে, সেখানে অন্য কলকারখানার সঙ্গে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পও স্থাপন করতে হবে। এতে মূল্য সংযোজন বেশি হবে এবং কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। ফলমূল ও মৎস্য উৎপাদন, বৃক্ষরোপণ এবং হাঁস-মুরগি পালন এসব কিছুতেই আমরা বিশ্বে এখন একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এগুলো প্রক্রিয়াকরণ করে যেন বিদেশে রফতানি করা যায়, সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন কৃষিতে। কারণ তিনি জানতেন, কৃষিই বদলে দিতে পারে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। কৃষিই দিতে পারে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে কৃষির সার্বিক উন্নয়নে কৃষিবান্ধব নীতি ও সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সার, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের মূল্যহ্রাস, কৃষকের সহজ শর্তে ও স্বল্পমূল্যে ঋণ সুবিধা প্রদান, ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগসহ নগদ সহায়তা দেওয়ায় কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব হয়েছে।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। উৎপাদন বাড়ায় মাছ ও মাংসে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছ এবং ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন মাংস উৎপাদিত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণে চতুর্থ এবং মাছ চাষে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। কৃষির এই অভাবনীয় অগ্রগতি থেকে আমরা বলতে পারি, এ দেশে কোনো মানুষ আর না খেয়ে থাকবে না। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। এ জন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নদী, নালা, খাল-বিলসহ সব প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে এবং সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার না করে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে। ধান চাষে গতানুগতিক সেচের বদলে পর্যায়ক্রমিকভাবে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতির ব্যবহার করতে হবে। এতে একদিকে পানির অপচয় রোধ হবে, অন্যদিকে ধানের ফলনও বৃদ্ধি পাবে এবং পোকা-মাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণও কম হবে। সেই সঙ্গে কৃষক ভাইদের দানাদার ইউরিয়া সারের পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহারের প্রতি নজর দিতে হবে। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে মাটিতে সারের ব্যবহার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কম লাগে এবং ধানের ফলন ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

কৃষি বাংলাদেশের জীবন এবং অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। এখনো দেশের শতকরা প্রায় ৪৩ ভাগ লোক জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে শতকরা ১ দশমিক ৩৭ ভাগ হারে এবং কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে প্রতি বছর শতকরা প্রায় একভাগ হারে। এ জন্য কৃষি গবেষণা জোরদারের পাশাপাশি শিল্পায়নের ওপরও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। আবার দেশের দুই ফসলি বা তিন ফসলি কৃষিজমি নষ্ট করে এখানে-সেখানে শিল্প-কালখানাও স্থাপন করা যাবে না। এক ফসলি অনুর্বর মাটিতে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে এবং এসব শিল্পের কাঁচামালের জোগানদাতা যেন হয় কৃষি, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিল্পের তরল, কঠিন বর্জ্যে যাতে মাটি, পানি, বাতাস ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট না হয়, সেদিকেও প্রখর দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না এবং মানুষের কল্যাণেও আসে না সেই ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গুর উন্নয়ন।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

yynetairoy18@yahoo.

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist