জি কে সাদিক

  ০৪ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

বিশ্ব মানচিত্রে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ

১০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনে সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতায় গত ১০ দিনে রাশিয়ার সর্বাধুনিক স্টিলথ প্রযুক্তির ফাইটার প্লেন সু-৫৭-এর টানা হামলায় প্রাণ হারিয়ে মুক্তিলাভ করেছে ছয় শতাধিক মানুষ। তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু। ২০১১ সালে সোনার গণতন্ত্র, বাক ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবিতে পশ্চিমাদের মদদে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তখন থেকেই পুরো সিরিয়া ও তার জনগণ গিনিপিনি। যুদ্ধকৌশল ও নতুন যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষা করার মাঠ সিরিয়া। মরুভূমিতে অস্ত্র পরীক্ষার চেয়ে সরাসরি যুদ্ধের মাঠে আর প্রতিপক্ষের নামে সাধারণ মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানো অনেক বেশি ফলদায়ক। তাতে সহজেই এর কার্যকারিতার ফল প্রত্যক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ অনুকূল ও সহযোগিতাপূর্ণ মাঠ পেয়েছে। রাশিয়ার সু-৫৭ নতুন একটি ফাইটার যার প্রথম ব্যবহার সিরিয়ায় হচ্ছে। পরীক্ষার ফল হিসাবে গত ৭ বছরে ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষের প্রাণ হারিয়েছে। যার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি শিশু। ৬১ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচের বাসিন্দা হয়েছে আর অভিবাসী হয়েছে ৪৮ লাখ। কিন্তু গণতন্ত্র কোথায়? কোথায় বাক আর ব্যক্তি-স্বাধীনতা? বাঁচার অধিকারটুকুও নেই। ঐতিহাসিক পল জনসনের একটা চরম সত্য কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন, ‘সেক্যুলারিজম (গণতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা করতে যে পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে, ইতিহাসে তার তুলনা নেই। আর যেখানেই এ মত প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তা হয়েছে রক্তপাতের মাধ্যমে।’ কথাটা তার কিন্তু ভাষ্য আমার। সিরিয়ানরা এই সত্যতার প্রমাণ। যে যাই হোক। এর শেষ কোথায়? কথিত বিশ্বশান্তির প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ তাদের আর কিছু করার নেই বলে জানিয়েছে। বিশ্বমোড়লরা স্বার্থ ছাড়া পথ চলে না। আর তাদের ভাষা হলো অস্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা ও আমেরিকার প্রভাব প্রায় গুটিয়ে গেছে। যদি তারা আবার আসে সেটা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব। তাহলে মুক্তি নয় আগুনে ঘি ঢালা হবে। আর রাশিয়া ও তার মিত্র তেহরান-আংকারা, যা করছে তাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লেশ মাত্র নেই।

বিদ্রোহ, সন্ত্রাস, আন্দোলন ও রক্তপাত এসবের আগে থাকে বঞ্চনা, শোষণ ও আরেক রক্তপাতের ইতিহাস। সিরিয়াতে যে রক্ত ঝরছে ও ঝরেছে সে কি শুধুই রক্ত? আমি মনে করি এগুলো ভবিষ্যতে আরো ধোঁয়াটে পরিবেশের জীব বপন। মানুষ জিজ্ঞাংসাকে লালন করে। মনে হয় সিরিয়ার বে-হিসাবি এতিম শিশুরা তাই করবে। কালের গর্ভে একদিন আসাদ হারাবে আর তার সঙ্গে বিলীন হবে দামেস্ক-মস্কো সম্পর্ক। কিন্তু আজ যারা এতিম, তারা হয়তো অনেকেই বেঁচে থাকবে। যারা বোনের কুলে শুয়ে থেকে দেখেছে বোনের মৃত্যু। বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তের আর্তি দেখেছে। জননীর চাপা পড়া মুখ দেখে নিজের জীবন বাঁচাতে দৌড়েছে। আর কোনো দিন দেখা হয়নি। কিন্তু তাদের হৃদয়পটে যে ছবি আছে, তা মুছা যাবে না। আর সেই ছবিই তাকে অনুপ্রাণিত করবে, প্রতিশোধ স্পৃহাকে চাড়িয়ে দেবে। যদি এই শিশু একদিন বোমা তৈরি করে, তার স্বজন হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে উদ্ধত হয়, তখন আমরা তাকে কী বলব? সন্ত্রাসী, জঙ্গি, বিদ্রোহী কোনটা? ইরাকে ২০০৩ সালে যে রক্ত ঝরেছিল, সেখান থেকেই আইএসের জন্ম। ইরাকে হামলার আগে বুশ প্রশাসন হোয়াইট হাউসে বক্তব্য দিয়ে আমেরিকানদের বলেছিল, ‘এই যুদ্ধের ফলে ইরাক হবে ‘উদারপন্থি গণতান্ত্রিক’ দেশ এবং নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক ‘বাতিঘর’। এই যুদ্ধ মানুষকে (ইরাকিদের) মুক্ত করবে এবং তার মূল উদ্দেশ্য স্রষ্টার দেওয়া স্বাধীনতার পুরস্কার ইরাকি জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়া।’ কিন্তু কোথায় ‘উদারপন্থি গণতন্ত্র’ আর কোথায় ইরাকিদের মুক্তি ও স্বাধীনতা? ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে ‘বাতিঘর’ নয়। বিদ্রোহের আর প্রতিশোধের ‘আতুরঘর’। যে যুদ্ধে দেড় লাখের বেশি সাধারণ ইরাকি প্রাণ হারিয়ে ছিল ৫০ হাজার শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। অবরোধ আর ত্রাণের স্বল্পতায় হাজার হাজার শিশু ও গর্ভবতী নারী অপুষ্টির শিকার হয়েছিল। আজ ইরাকের মানচিত্র আছে, সরকার আছে কিন্তু স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব বলে কিছুই নেই। একদিন সিরিয়া হবে ইরাকের চেয়েও ভয়াবহ ক্যানসার আক্রান্ত দেশ। ২০১৬ সালে আলেপ্পোর মাদায়া, ফোয়া ও ফারিয়া শহরে সরকারি অবরোধে কয়েক হাজার মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে রাস্তায় অনাহারে মারা যাওয়া মানুষের মৃতদেহ দেখা গেছে। এখন পূর্ব ঘৌতার অবস্থা আরো ভয়াবহ। ইতিহাসের ধারা অঙ্কের সূত্রের প্রয়োগ হচ্ছে, তাই ভবিষ্যৎও ভিন্ন হবে না।

ঐতিহাসিক স্যামুয়েল হানটিংটন একবিংশ শতকে আটটি সভ্যতার সংঘাতের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে কনফুসিয়াস ও ইসলামিক সভ্যতার দ্বন্দ্ব হলো প্রধান। গত শতকের শেষ পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাও একবিংশ শতকে পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে দুটি সভ্যতার সঙ্গে সংঘাতের কথা উল্লেখ করেছেন। এক. কনফুসিয়াস তথা চৈনিক সভ্যতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব, যা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীন বর্তমান বিশ্বশক্তি। তাকে দমন করা পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্তিম দ্বীপ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব হতে পারে। আবার উত্তর কোরিয়া প্রশ্নটাও বড় হয়ে আসছে ক্রমে। দুই. ইসলামিক সভ্যতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই মুসলিম দেশগুলোর কপাল পুড়তে শুরু করে। আর লাখ লাখ অভিবাসী জীবন বাঁচাতে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি জমাতে থাকে। ফলে ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলিমদের সংখ্যা বদ্ধি পাবে, যা ইউরোপে উগ্র খ্রিস্টানদের রাজনীতিতে ভালো ‘ব্যাকাপ’ দেবে। ২০১৭ সালে জার্মানির জাতীয় নির্বাচন এর উদাহরণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একই কথা আসে। আর এখন এটা আরো কারণ ইউরোপজুড়ে উগ্র-রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ঘটছে, যা ইসলামিক সভ্যতার সঙ্গে দ্বন্দ্বকে চাউর করবে। ফলে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অমুসলিম বিদ্বেষ জন্ম হবে। যাদের মদদে ও সহায়তায় মুসলিম ভূমি রক্তাক্ত হয়েছে, তারা একদিন রক্তের শোধ নিতে চাইবে। তখন সন্ত্রাস, জঙ্গি, বিদ্রোহী, মানবতার শত্রু তকমায় হামলার দরকার হবে।

ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটা শেষ হয়নি এখনো। যদিও আমেরিকা সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু পিকেকে (কুদিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি), সিরিয়ার নুসরা ফ্রুন্ট ও ওয়াইপিজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, যা পরোক্ষ যুদ্ধ। সুতরাং এটা স্পষ্ট, এই বিদ্রোহীদের দমন করতে আরো যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ খরচ করতে হবে। তাতে প্রাণ ঝরবে আরো। যে রক্তপাত হবে সেটা নতুন সিরিয়া গঠনের জন্য কোনোই কাজে স্বাদ দেবে না। যেমন ইরাকে দেয়নি। অন্যদিকে সিরিয়াতে এখনো বিদ্রোহীরা শক্ত অবস্থানে আছে। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদন মতে, সিরিয়ায় এখনো ২০ হাজারের বেশি সরকারবিরোধী বিদ্রোহী রয়েছে। যার মধ্যে ‘আর্মি অব ইসলাম’র ১০ হাজার যারা সৌদি সমর্থিত। কাতার ও তুর্কি সমর্থিত ‘ফাইলাক আল-রাহমান’র ৮ হাজার বিদ্রোহী রয়েছে। ‘আহরার আল-শাহ’র ১২০০ ও ‘লেভান্ত লিবারেশন কমিটি’র ৬০০ যোদ্ধা আছে। একমাত্র ‘আর্মি অব ইসলাম’ বাদে আর সব বিদ্রোহীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে আল-কায়েদার। যারা বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক বিস্তার করে আছে। তাই সিরিয়ার এই যুদ্ধকে শেষ বলার কোনো গড় মিলছে না। বরং যাত্রালগ্ন বলা যায়। কারণ ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের কৌশলগত পরাজয় হয়েছে। তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়নি। সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা পরাজয় হলেও শেষ হবে না। কারণ এরা সৌদি, কাতার, তুরস্কর মতো দেশের সাহায্যপ্রাপ্ত, তা ছাড়া এরা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গেও যুক্ত। দৃশ্যত রিয়াদ-আংকারা-দোহা যতই সাহায্য করার কথা ‘না’ বলুক কিন্তু তারা সাহায্য করছে। ভবিষ্যতেও করবে। কারণ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হবে। তা না হলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্রে ইরানের প্রভাব রিয়াদ মানতে পারবে না। অন্যদিকে রিয়াদের প্রভাব মানবে না তেহরান বা আংকারা। ফলে আজ যারা রক্তাক্ত হচ্ছে কাল তারা দাবার ঘুঁটি হবে বা হতে পারে। আর সেই দাবার বোর্ডের খেলোয়াড় হিসেবে আবারও আবির্ভাব হবে পুরোনো মিত্রের। এ ছাড়া ভয় আছে ধর্মীয় সন্ত্রাসের। সরকারি বাহিনীর পক্ষ হয়ে রাশিয়া-ইরান সিরিয়া বিদ্রোহীমুক্ত করতে সচেষ্ট। ক্লোরিন গ্যাস থেকে শুরু করে যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। নিজের সীমান্ত রক্ষার জন্য সিরিয়ার অনুমোদন ও নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি ব্যতিরেখেই তুরস্ক ওয়াইপিজে বিদ্রোহীদের দমনে অভিযান চালাচ্ছে। তাই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট, সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষণ আপাতত নেই। রক্ত ঝরিয়ে যারা বেঁচে থাকবে, তারা কতটা রক্তপাতহীন শান্তির দীক্ষা নেবেÑসেটাও বড় প্রশ্ন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist