হাসানুজ্জামান তুহিন

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

স্মরণ

একুশ এবং একজন আলী আজমল

সর্বসাধারণের কাছে বুলবুল ডাক্তার নামেই পরিচিত। শাহজাদপুর তথা বৃহত্তর পাবনা জেলার খ্যাতিমান চিকিৎসক। চিকিৎসা ক্ষেত্রে তার যে অসাধারণ সাফল্য ছিল, তাতে তিনি রীতিমতো অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু চিকিৎসাকে তিনি অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নেননি। খুব সহজ-সরল জীবনযাপনের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন এবং তার অনুশীলনও করেছেন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেওয়ায় এমবিবিএস শেষবর্ষের পরীক্ষার তিন মাস আগে তদান্তীন পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বায়ান্নর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বহিষ্কৃত প্রায় সবাই এমবিবিএস ডিগ্রি গ্রহণ করলেও বুলবুল ডাক্তার (ডা. আলী আজমল) তার চারপাশে মানুষ ও রোগীদের ছেড়ে আর কখনো ডিগ্রি লাভের পেছনে ছোটেননি। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কড়া বাম ধারার মানুষ বলে, নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে সেবায় রত ছিলেন আমৃত্যু। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের কমনরুম-বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন মেধাবী এই ছাত্রনেতা। ছাত্র সংসদের প্রায় সবাই গ্রেফতার হওয়ার পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। তাই সব আন্দোলনেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে ছাত্রসমাজ ছিল বিক্ষুব্ধ। সে সময়ে হরতাল চলাকালে ঢাকা সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এবং ২ নম্বর গেটের সামনে পিকেটিং করার সময় প্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আজমল। সেই থেকে ৫২-এর ২১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত মোট ১১ বার কারাবরণ করেন এবং ১৭ বার পুলিশের তালিকায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামি হিসেবে নাম উঠে তার। সে সময় এবং এ সময়ে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিংপড়–য়া ছাত্ররা তেমন কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে। তিনি ছিলেন এই ধারার বাইরে ভিন্নধারার এক মানুষ। আমাদের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। এই ইতিহাসের অনেক ঘটনা আজও অজানা ও অনালোচিত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের গবেষক এম আর মাহবুব একুশের আলোচিত ও নেপথ্য কথায় বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এম আর আখতার মুকুলের প্রস্তাবক্রমে ছাত্রনেতা গাজীউল হক ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের মতানুসারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গাজীউল হক কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় সমবেত ছাত্রছাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন রকম সেøাগান দিতে থাকেন। এ সময় সভায় উপস্থিত আবদুস সামাদ আজাদের এক প্রস্তাবক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, ১০ জন করে এক একটি দল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে। অনেকে পাঁচজনের দলের কথাও বলেছেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের নেতৃত্ব নিয়ে মতভেদ আছে। অলি আহাদসহ আরো অনেকের মতে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আলী আজমল প্রথম দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অলি আহাদ জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ গ্রন্থে বলেছেন : ‘মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আজমল হোসেনই ২১ ফেব্রæয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হইতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত প্রথম দলটির নেতৃত্ব দান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সদর দরজা সংলঘœ পূর্বদিকের রাজপথে অপেক্ষমাণ পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন।’ (সূত্র : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ অলি আহাদ) ভাষাসৈনিক বদরুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘দশজনের প্রথম ব্যাচ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রনেতা আজমলের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন।’ এইভাবে যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছিল প্রথম যাদের পুলিশ ধরেছিল তাদের মধ্যে ছিল ডক্টর আলী আজমল (মেডিক্যাল)... (সূত্র : ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল-বদরুদ্দীন উমর পৃষ্ঠা ২৩৮)। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক মোহম্মদ আমীন ‘রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের কথা’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ২৯) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘২১ ফেব্রæয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয় সদর দরজাসংলগ্ন পূর্বদিকের রাজপথে বের হওয়া মাত্র অপেক্ষমাণ পুলিশ আজমল হোসেনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু মোহাম্মদ সুলতান, গাজীউল হক প্রমুখ ভাষাসৈনিকদের মতে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে গঠিত প্রথম দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী। অতএব হাবিবুর রহমান শেলী নয়, আজমল হোসেনই ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। হাবিবুর রহমান শেলী নিজেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন মর্মে কোথাও লিখেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, কে কোন দলে ছিলেন বা কে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ও রকম উত্তেজনাকর মুহূর্তে তা খেয়াল রাখার কোনো অবকাশ ছিল না।’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের নেতৃত্ব প্রদান প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান শেলী নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন : ‘লোকপ্রবাদ বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারিতে আমিই নাকি সেই প্রথম ছেলে যে সমাবেশ-নিষেধাজ্ঞার আইন অমান্য করে। আমি সেই লোকপ্রসিদ্ধির ব্যাপারে এক লিখিত না-দাবি দিয়ে জানাই ওই আত্মম্ভরী ভাষাসৈনিক শব্দটি জন্মের আগেই; আমি প্রথম কি না সে আমার জানা নাই।’ (সূত্র : প্রথম আলো, ২১ ফেব্রæয়ারি ২০০৮)।

১৪৪ ধারা ভাঙার মিছিলে আলী আজমলের ভ‚মিকা প্রসঙ্গে আহমদ রফিক বলেছেন, ‘ছাত্রদের দশজনার মিছিল দ্রæত রেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে, বাইরে অপেক্ষমাণ পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলতে শুরু করেছে। রাস্তায় ট্রাকের ওপর দীঘল হালকা শরীর আনোয়ারের পাশাপাশি ঘনশ্যাম বলিষ্ঠ দেহ আলী আজমল দাঁড়ানো। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার ওপর মুঠো পাকানো হাত, প্রতিবাদের সাহসী প্রতীক।’ (সূত্র : স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ আহমদ রফিক, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা আগস্ট ২০০৩, পৃষ্ঠা ১৩৬-১৩৫)। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঐতিহাসিক মিছিলে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটা তখন মুখ্য বিষয় ছিল না। কার নেতৃত্বে প্রথম দলটি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে সেটা সুনির্দিষ্ট করে রাখার মতো পরিবেশ হয়তো তখন ছিল না। জ্যেষ্ঠ বা ছাত্রনেতা যারা ছিলেন এক একটি দলের মধ্যে তার বা তাদের ওপর অলিখিতভাবে এমনিতে নেতৃত্ব বর্তে গেছে। হয়তো মুহূর্তের মধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে, এই দলের ইনি বা এরা নেতা, অন্যরা সবাই হয়তো তার খবরও রাখেনি। (সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশীর আলহেলাল, আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩৬২)। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনও অনুরূপ মন্তব্য করে বেেছন, ‘সে এক অসাধারণ ব্যাপার। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে চরম উত্তেজনা তারা কারাবরণ করবে; কিন্তু পরাজয় বরণ করবে না। কে নেতৃত্ব দিয়েছে, কে প্রথম বেরুল সেটা বড় কথা নয়, কার আগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।’ (সূত্র : লেখকের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে আবদুল মতিন, ৪ জুলাই ২০০৮)।

১৯২৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলাধীন পাড়কোলা গ্রামের এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলী আজমল। তার বাবা মুহম্মদ সোলায়মান এবং মা জোবেদা খাতুন। বাবার চাকরি সূত্রে আজমলের লেখাপড়া শুরু হয় রাজশাহীতেই। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এই উভয় পরীক্ষাতেই তিনি অভিভক্ত বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সম্মিলিত মেধা তালিকায় যথাক্রমে ম্যাট্রিকুলেশনে ১৩তম এবং ইন্টারমিডিয়েটে ১১তম স্থান লাভের অসাধারণ গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চলে আসেন তিনি। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি নেতৃত্বদানের ছিল অসাধারণ যোগ্যতা। তার জীবনের সমস্ত কাজকর্মে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তার স্ত্রী খুরশিদ আজমল পুতুল। সেই স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি অনেকটা চুপচাপ হয়ে যান। ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা পাঁচ দিন অচেতন থাকার পর ৩ অক্টোবর পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুর পর শাহজাদপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হজরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়ামেনী (রহ.)-এর মসজিদ ও মাজারসংলগ্ন দক্ষিণ পাশের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। প্রতি বছর ২১ ফেব্রæয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় তার কবরে পুষ্পার্পণসহ তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষাসৈনিকের প্রতি যোগ্য সম্মান মর্যাদা বা স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি, যা ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞাই নামান্তর মাত্র।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist