এস এম মুকুল

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বাতিঘর

অবহেলিত কেন গ্রন্থাগার

বই মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম উপায়। যদিবা এখন সেই স্থান দখল করেছে ফেসবুক, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ইউটিউব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব করে দৃশ্যমান সামাজিক দক্ষতা বাড়লেও স্থায়ী মননশীলতার কোনো উন্নতি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ফেসবুক, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ইউটিউবসহ অন্যসব সামাজিক মাধ্যমগুলো বরং প্রজন্মকে আরো অসহনশীল, অশালীন, অমার্জিত এমনকি অসামাজিক করে তুলছে বলে হামেশা অভিযোগ উঠছে। আচারে অনুষ্ঠানে, সামাজিকতায়, ঘরে-বাইরে সবখানে এখনকার বইপ্রীতিহীন ডিজিটাল প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক অভিলাষের ছিটেফোঁটাও লক্ষ করা যায় না। এসব সামাজিক মাধ্যমের অনেক ভালো দিক থাকলেও খারাপ বা নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে, যা বইপড়–য়া প্রজন্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রশ্ন আসতে পারে-তাহলে কীভাবে এই অবস্থা থেকে উত্থরণ ঘটবে। এ বিষয়ে প্রমথ চৌধুরীর উক্তিটি স্মরণে আনতে পারি, তিনি বলেছেন-‘আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে। প্রকৃত অর্থে লাইব্রেরি হচ্ছে মন নিরাময়কেন্দ্র বা মনের হাসপাতাল। আমাদের দেশে যত্রতত্র যেভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাসপাতাল গড়ে উঠছে, সে হারে যদি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা যেত তাহলে সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যেত। সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা, অসামাজিকতার প্রভাব কমে যেত। দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে- প্রজন্মের সন্তানরা যেভাবে সামাজিক ডিজিটাল মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে অকাতরে সময় নষ্ট করছে-যদি তারা বই পড়ার পেছনে এর অর্ধেক সময় ব্যয় করত, তাহলে মেধায়, মননে, সৃজনে একটি রুচিশীল, মানবীয় বোধসম্পন্ন প্রজন্ম দেশকে আলোকোজ্জ্বল করে দিতে পারত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর দুটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মান না বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বেড়েছে বহুলাংশে। আমাদের দেশে হাসপাতালের মতো পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগারও স্থাপন করা গেলে মননশীল জাতি হিসেবে বাঙালিদের নতুন পরিচয় ঘটবে।

দেশের সর্বজনীন শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজনে গড়ে উঠে গণগ্রন্থাগার। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে দেশের গ্রন্থাগারগুলোর রুগ্ণ অবস্থা এবং তরুণ-তরুণীদের গ্রন্থাগারবিমুখিতা নিয়ে প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা মোটেও জাতীয় মননশীলতার জন্য ভালো ইঙ্গিত নয়। গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে জাপানকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। কেননা জাপানি গ্রন্থাগারগুলো অনেক আকর্ষণীয়। সেখানে পাড়া ও মহল্লায় নগর প্রশাসনের গ্রন্থাগার রয়েছে। প্রতিটি নগর ও অঞ্চলের পৌর বা নগর গ্রন্থাগারে রয়েছে দুটি বিভাগ-একটি শিশুদের জন্য, অন্যটি বড়দের। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপান দ্রুত শিক্ষা এবং গ্রন্থাগারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল শিক্ষাগ্রহণ ও গ্রন্থপাঠের বিকল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুতে হতে পারে না। জাপানিরা বাস্তবিক অর্থেই মনে করে-নিরক্ষর জনগণ দিয়ে কিছুকাল কাজ করানো সম্ভব, তবে চিরকাল নয়। সেখানে প্রতি মাসে গ্রন্থাগারে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ঋতুভিত্তিক, ঘটনাভিত্তিক গ্রন্থ ও বিশেষ সাময়িকী প্রদর্শনী, ঐতিহাসিক দলিলপত্র-নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়। জাপান ছাড়াও পৃথিবীর উন্নত দেশে বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে এমনকি হাসপাতালেও আছে বুকস্টল। আমাদের দেশে সরকারি গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা সুকরুণ। বেসরকারি উপজেলা পর্যায়ে পাঠাগারগুলোয় চলে রাজনীতির প্রভাব আর দলবাজির আসর। আমরা জানি, উন্মুক্ত শিক্ষার একমাত্র বাহন হলো গণগ্রন্থাগার। গ্রিস দার্শনিক অ্যারিস্টটল, প্লেটোর মতে মহাজ্ঞানীরা গবেষণার তথ্যভান্ডার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করে রাখতেন।

বলা হয়ে থাকে, গ্রন্থাগার সামাজিক শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ। গ্রন্থাগার হলো জাতির দর্পণ। অবিভক্ত বাংলার গ্রন্থাগার আন্দোলন শুরু হয়েছিল পরাধীন ভারতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী গ্রন্থাগার। এসব গ্রন্থাগারে থাকত দেশপ্রেমিকদের জীবনীগ্রন্থ ও দেশ-বিদেশের মুক্তি বা স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে লেখা বই। আর এসব গ্রন্থাগারের মাধ্যমে পাড়ায়-মহল্লায় তরুণ যুবসমাজকে সংগ??ঠিত করা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯২৫ সালে ২০ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক কনভেনশনের মাধ্যমে গঠিত হয় বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ। প্রথম সভাপ?তি নির্বাচিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রোমে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। যতদূর জানা গেছে-রোম ছাড়াও প্রাচীনকালে ব্যাবিলন, মিসর, চীন, ভারত ও তিব্বতে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। মুসলমানদের শাসন আমলে অনেক সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর সভ্যতার ইতিহাসে স্পেনে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশটি বিশ্বের গুণী-জ্ঞানীদের তীর্থভ‚মিতে পরিণত হয়েছিল। ড. কুদরত-এ-খুদা প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে হৃৎপিÐের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রতি বছর ৫ ফেব্রæয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে পালনে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তার পরও প্রশ্ন, গ্রন্থাগার কেন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত? দেশের উন্নয়ন ভাবনায় জ্ঞান-তথ্যের সেই উৎস অর্থাৎ গ্রন্থাগারই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অধিকাংশ গ্রন্থাগারেই পাঠকক্ষের পরিসর সন্তোষজনক নয়। অভাব রয়েছে চেয়ার-টেবিলের। বইয়ের স্বল্পতা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের গ্রন্থাগারগুলো। জানা গেছে, বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে বই কেনার কোনো বাজেট থাকে না। ঢাকায় গণগ্রন্থাগার অধিদফতর নতুন বই কিনে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে সরবরাহ করে। ৬০ শতাংশ গ্রন্থাগারেই বসার জায়গা অপ্রতুল। ২১ শতাংশ গ্রন্থাগারে এ সমস্যা প্রকট। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে ৭৪ শতাংশ গ্রন্থাগার। আলাদা পাঠকক্ষেরও ব্যবস্থা নেই অনেক গ্রন্থাগারে। পৃথক হলরুম ও সভাকক্ষ নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লাইব্রেরি। বাংলাদেশে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার বিদ্যমান সমস্যা ও সম্ভাবনা যাচাইয়ে সরকার, ব্র্যাক ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে একটি জরিপ চালিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৩ শতাংশ ব্যবহারকারীর মতে, বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলো এখনো প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের বাইরে রয়ে গেছে। প্রায় অর্ধেক ব্যবহাকারীর মতে, গ্রন্থাগার সেবার মান কাক্সিক্ষত মানের নয়। সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোর মাত্র ৪ শতাংশে পাঠকদের জন্য ইন্টারনেট সেবা উন্মুক্ত।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গণগ্রন্থাগার আছে ৬৮টি। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত গ্রন্থাগার রয়েছে ১ হাজার ৬০৩টি ও এনজিও পরিচালিত ৩ হাজার ৫৯৬টি। বলতে দ্বিধা নেই মেধাবী ও মানবীয় সমাজ, সুনাগরিক গঠন সর্বোপরি সুশীল জাতিগঠনে খুবই হতাশাজনক খবর এটি। উন্নয়নের জোয়াড়ের পাশাপাশি জাতির জ্ঞান বিকাশে উন্নয়নে এত অবহেলা কাম্য নয়। বর্তমান সরকার সামাজিক উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে নানান মেয়াদি প্রকল্প চালু করছেন। অথচ জ্ঞাননির্ভর মেধাবী প্রজন্মের জন্য, সমাজ তথা রাষ্ট্রের মানবীয় বিকাশে দেশের গ্রন্থাগারগুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ কেন নেই। কী কারণে এই দুরবস্থার শিকার হলো গ্রন্থাগারগুলো-সরকারের কাছে জাতির একটি কঠিন প্রশ্ন। দেশের প্রত্যেকটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা আবশ্যক। চলতি গ্রন্থাগারগুলোয় জনবল বাড়ানো দরকার। দেশের সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পাস গ্রন্থাগার চালু করা এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই নীতি বাধ্যতামূলক করা দরকার। সরকার গ্রন্থাগারগুলোয় বছরে ২০০ কোটি টাকার বই দিলে দেশের প্রকাশনা শিল্পও ঘুরে দাঁড়াবে। দেশে অনেক লেখক, গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট পেশাদার তৈরি হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম স্কুল থেকে বইপ্রেমী হয়ে উঠলে তবেই না আমরা মননশীল জাতি উপহার পাব। বই শিল্প বিকাশে সরকারের বড় ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা অতি আবশ্যক। প্রকাশনাকে শুধু একটি নান্দনিক মেধা বিকাশক শিল্পই নয় জাতি গঠনে এবং সৃজনশীল সংস্কৃতির সম্প্রীতি ঘটাতে এ শিল্পের ভ‚মিকা অগ্রগণ্য। এজন্য সৃজনশীল প্রকাশনার প্রথম ক্রেতা হতে হবে সরকারকে। সরকার ক্রেতা হয়ে বইপঠনকে জনপ্রিয় করে তুললে প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব তৈরি হবে। সামাজিক অসংগতি ও সংঘাত কমবে। এ কাজে সরকারেরই লাভ বেশি। সরকার তার পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদে প্রতি বছর ১০০ কোটি করে ৫০০ কোটি টাকার বই কিনলে পাল্টে যাবে প্রকাশনা শিল্পের অবয়ব। তবে সরকারের ক্রয়নীতিতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। তা না হলে প্রকাশনার মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ভেবে দেখার মতো বিষয়, আমাদের পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষার্থীও সংখ্যা কত কোটি। আমাদের সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সৃজনশীল বই কিনে পাঠাগার স্থাপন করা বাধ্যতামূলক হলে শতকোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে কই।

লেখক : উন্নয়ন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist