মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নতুন ভাবনা

এইচএসসি পরীক্ষা

মহাদুর্যোগ ও মহামারী চলছে দেশে। যা লিখতে গেলেও মহাকাব্য হয়ে যাবে। ১০নং মহাবিপদ সংকেতের সঙ্গে বড় রকমের জাতীয় দুর্যোগ বললেও বেশি হবে না। চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রতিদিনই ফাঁস হয়েছে। কোনোভাবেই সম্ভব হয়নি প্রশ্নফাঁস রোধ করা। পরীক্ষাগুলোও বাতিল হচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘প্রশ্ন আগেও ফাঁস হতো, কিন্তু এখন তা বিস্তৃত হচ্ছে ইন্টারনেটকে মাধ্যম করে, বলতে পারেন প্রযুক্তির বিড়ম্বনা’। সচিব মহোদয় তো আরেক অপ্রকাশ্য ও গোপনীয় গুপ্তরহস্য উন্মোচন করেছেন। ‘আগেও ফাঁস হতো’। তাহলে আগেও কেন ফাঁস হতো? প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য অকপট, ছলাকলাহীন ও শিশুসুলভ মেজাজে সচিব স্বীকার করলেন। তখন কি যথোপযুক্ত বা সমুচিত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? অবশ্যই হয়নি। অর্থাৎ করনেওয়ালারা করেই গেছেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা ছিলেন রহস্যময় সাক্ষীগোপাল মাত্র! এখন সচিব বলছেন ‘প্রযুক্তির বিড়ম্বনা’। এগুলো আসলে কোনো যুক্তিযুক্ত উক্তি কি? দায়িত্ববানদের অশোভন কথায় সরকারের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও অসহায়ত্বই ফুঠে উঠছে। এরপর তিনি অনর্থক, অযথা, কলুষিত ও কলঙ্কিত করছেন বেচারা ইন্টারনেটকে! উৎসমুখ বন্ধ করতে না পারলে যেমন নির্গমন বন্ধ হয় না, তেমনি এতদিনে প্রশ্ন ফাঁসের মূল জায়গা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে আজ প্রযুক্তির ফাঁদে পড়ে লজ্জাজনক লেজেগোবরে অবস্থা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।

আগামী ২ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। এ পরীক্ষা নকল ও প্রশ্ন ফাঁসমুক্তসহকারে সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে কীভাবে সম্পন্ন করা যায় এ নিয়ে এখনই ভাবুন। ব্যবস্থাপনার রীতিতে ইতোমধ্যে উক্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর জেলা প্রশাসকের পাঠানো ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় প্রশ্নপত্র পাঠানো শুরু হবে। দেশের বাইরেও বিভিন্ন কেন্দ্রে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র পাঠাতে ১৫-২০ দিন সময় লাগে। এজন্য অন্যান্য পরীক্ষার তুলনায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রশ্নপত্র অনেক আগেই ছাপা শুরু করতে হয়। ছাপা শেষে প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসকদের ট্রেজারিতে পাঠানো হয়। পরীক্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত এই প্রশ্নপত্র গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হলেও প্রচলিত পদ্ধতিতে এত আগে প্রশ্নপত্র তৈরি ও ছাপা এবং এত স্তরে আনানেয়ার সাথে একাধিকবার হাতবদল থাকার কারণে ফাঁসের আশঙ্কা থাকে।

প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা, পাঠ্যবিষয় ও পাঠ্যক্রমে নিত্যনতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এক্সপেরিমেন্ট চলছে কখনো নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নে, কখনো রচনামূলক আবার সৃজনশীল নামের পদ্ধতি প্রয়োগ করে। ১৯৯২ সালে এসএসসিতে চালু করা ৫০ নম্বরের এমসিকিউতে ৫০টি প্রশ্ন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তখন নৈর্ব্যত্তিক ও রচনামূলক মিলে ৩৩ নম্বর পেলেই পাস। ফলে শিক্ষার্থীরা রচনামূলক অংশের লেখাপড়া বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ এমসিকিউ পড়লেই হতো। এতে পাসের হার রাতারাতি বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে ৫০ এমসিকিউর পরিবর্তে পুরো বই থেকে এমসিকিউ নির্ধারণ করে। এরপর শুরু হয় পরীক্ষার হলে এমসিকিউর উত্তর বলে দেওয়ার ঘটনা। পরে এমসিকিউতে ৪০ নম্বর ও এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক উত্তর বলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। ২০১৫ সাল থেকে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র‌্যাংকিং বাতিল করা হয়। তাতেও কাজ হয়নি। গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় এমসিকিউ ৩০ নম্বর করা হয়। এভাবে নিত্যনতুন পদ্ধতি এক্সপেরিমেন্ট করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গিনিপিগে পরিণত করা হচ্ছে। এতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য প্রজন্ম।

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তিবিদরা নানামুখী পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন- ইলেকট্রনিক খাম- এতে সহজে অনুমেয় হবে কোথায় কখন খোলা হচ্ছে প্রশ্নপত্রের খাম। বিশেষায়িত ব্যাগ- যা একবার ব্যবহারের পর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে না। ফলে কেউ প্রশ্নের প্যাকেট খুললে দ্বিতীয়বার আর আটকানোর সুযোগ পাবে না। ইন্টারনেট জ্যামার-পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোয় ইন্টারনেট জ্যামার ডিভাইস ব্যবহারের পরামর্শ প্রযুক্তিবিদদের। পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপা; এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা। যাতে কম্পিউটার এবং প্রিন্টার ব্যবহার করে মাত্র ২০-২৫ মিনিটে পাঁচ শ থেকে এক হাজার প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করা সম্ভব। অনস্ক্রিনে প্রশ্ন- কেন্দ্রে প্রজেক্টরের মাধ্যমে অনস্ক্রিনে প্রশ্নপত্র থাকবে, সেটা দেখে উত্তর দেবে শিক্ষার্থীরা। এসব বিষয়গুলো সামনে রেখে বাস্তবতার নিরিখে খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist