ইয়াসমীন রীমা
শিশু
মিথ্যা বলার অভ্যাস
একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর এ প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয় যে, শিশুটি দেখতে কেমন হয়েছে? কার মতো হয়েছে? কালো না ফর্সা? স্বাস্থ্য ভালো না খারাপ? ইত্যাদি। সুন্দর হলে তো কথাই নেই। বাবা-মায়ের আত্মীয়স্বজনের খুশির সীমা থাকে না। তারপর ধীরে ধীরে শিশুটি বড় হতে থাকে এবং একসময় কথা বলা শুরু করে। কিন্তু পরিবারের অলক্ষ্যে অনেক শিশু মিথ্যা বলা শুরু করে। তার কল্পনার জগতের নানা সব কথা। এমনকি কোনো কোনো সময় অভিভাবকদের শঙ্কিত করে ফেলে। আতঙ্কিত করে তোলে। পরক্ষণে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পুরো ব্যাপারটি ছিল মিথ্যা বা কাল্পনিক। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি না রাখার কারণে বিষয়টি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়ায়। তাই শিশুদের এই মিথ্যা বলার প্রশ্রয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সর্তক থাকতে হবে অভিভাবকদের। ভ‚তের ভয় দেখিয়ে যদি শিশুদের ঘুম পাড়ানো হয়, তবে সে ভ‚ত দেখেছে বললে আপত্তি করা চলে কি! প্রথম রূপকথার গল্প শোনা বয়সে সে মনের পক্ষীরাজ ঘোড়ার কত তেপান্তরের মাঠে ঘুরে আসে সেই কল্পনাবিলাসের ছিটেফোটা প্রকাশ করারও ইচ্ছা হতে পারে। কল্পনা ছাড়াও শিশুরা মিথ্যা বলে। অহেতুক অহংকার প্রদর্শন করার ইচ্ছা একটা বয়সে আসতে পারে। বাড়ি-গাড়ির গল্প শুনিয়ে চমক লাগিয়ে দেওয়া যায়, এ কথা সে বড়দের দেখে শেখে। সঙ্গী-সাথীর চোখে নিজেকে প্রকান্ড একটা কিছু প্রমাণ করতে দু-একটা মিথ্যার আশ্রয় হয়তো নেয়। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে কোনো একটা অভাব থেকেই এই মিথ্যার সৃষ্টি। স্কুলের পড়াশোনায় হয়তো সে পিছিয়ে আছে, হয়তোবা খেলায় সে প্রতিবেশী ছেলেমেয়ের সমান নয়। কাজেই অন্যত্র নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত। এমনও হতে পারে, মনের গহীনে কোনো এক অজানা ভয় থেকে মিথ্যার সৃষ্টি। এই ধৈর্য সবচেয়ে পূর্বে দরকার। কেন ভয়, কীসের ভয়- মা বাবা যত সহজে জানতে পারবেন, তেমন কি আর মনস্তত্ত¡বিদ জানবেন! শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যও শিশুরা মিথ্যা কথা বলে থাকে।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট মনোরোগ বিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, শিশুদের শাস্তির বিধানে প্রচুর শিথিলতা প্রয়োজন। অহেতুক নির্যাতনের পেছনে মূলত দায়ী সীমাহীন অজ্ঞতা। শুধু শিক্ষক নয়, অভিভাবকরাও এ জন্য দায়ী। অনেক পিতা-মাতাও নির্যাতন করেন যদিও সন্তানের প্রতি তাদের মঙ্গলকামনা আছে। শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি তাদের কোমল মনকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং সে অবলীলায় মিথ্যা বলা শুরু করে দেয়। শৈশবে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত যেকোনো শিশুই ভবিষ্যতে বিকারগ্রস্ত হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অপরাধী শিশুকে নয় বরং তার নেতিবাচক আচরণকে সমালোচনা করতে হবে। নিজেরা আচার-আচরণে নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। শিশুর সামনে কথাবার্তায় উগ্রতা প্রদর্শন করা যাবে না। লাগাতার খুত ধরা খ্যাঁচ খ্যাঁচ করা, ভয় দেখানো বা হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
বিনা অনুমতিতে কোনো কাজ করে শিশু যদি অস্বীকার করে, তখন শাসন যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তবে ভবিষ্যতে হয়তো আরো সাবধানে গোপন করবে অথবা অগ্রাহ্য করতে শিখবে। অবশ্য হয়তো কখনো একটু-আধটু মিথ্যা কথা ভুলে গিয়েও বাচ্চারা বলে। শিশু মা-বাবা বা প্রিয়জনের ভালবাসা হারাতে চায় না, তাই এমন কাজ বা তাদের অসন্তোষের কারণ হতে পারে তার স্মৃতি নিজের অজ্ঞাতসারে ভুলে যেতে চায়।
‘ওয়ার্ক ফর বেটার চাইল্ড অব বাংলাদেশ’ তাদের একটি গবেষণায় জানা গেছে, ৬৪ শতাংশ শিশু মিথ্যা কথা শিখে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে, ৩৭ শতাংশ পরিবেশের কারণে, ২৯ শতাংশ পরিবারের সদস্যাদের আচরণ থেকে এবং ৪৭ শতাংশ শিখে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নিজেকে জাহির করার জন্য।
যে ধরনের মিথ্যাই হোক, প্রিয়জনের আদর-স্নেহ তার মূলে পরিবর্তন করতে পারে। ঘরে শিশুর সমাদর হলে সে নির্ভয় হতে পারে ও আত্মনির্ভরতা শিখে। আত্মনির্ভরতা সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। কিন্তু কেবল কাজে নয়, চিন্তারও আত্মনির্ভর হয়ে গড়ে ওঠলে ভালো-মন্দ সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ বুঝবে। অনেক অভিভাবক তাদের চিন্তাভাবনা ভালো-মন্দবোধ তার ওপর চাপানোর চেষ্টা অনেক মঙ্গলকামনা মনে করি। পিতা-মাতার অসফল আশা-আকাঙ্খা সন্তানের জীবনে সার্থক হোক, এরকম ভাবও অলক্ষ্যে জন্মায় তখন আমরা তার ব্যক্তিগত স্বাধীন সত্তা গড়ে ওঠার পথে অন্তরায়ও হতে পারে। তাদের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিফলিত করার প্রয়াসে তাকে চেপে রাখতে পারে। আমদের বিবেক তাকে ধার না দিয়ে তার বিবেককে জাগ্রত করবার সহায় হলে একদিন তার বিবেচনা শক্তি প্রখর হবে। মিথ্যা বললে শেষ পর্যন্ত ঠকতেই হয়, এটা সে নিজেই বুঝবে। বিবেক অন্তরের রক্ষী মনস্তত্ববিদের ভাষায় তাকে সবল রাখতে সাহায্য করে। আপনা থেকেই শিশু সুস্থ মন নিয়ে গড়ে উঠবে।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট
"