মাহফুজ আল মাদানী

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ধর্ম

সবার কল্যাণেই আল্লাহর বিধান

মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন প্রজ্ঞাময়। তার প্রজ্ঞা সর্বদা সবখানে বিরাজমান। তার দেওয়া বিধিবিধানে প্রজ্ঞাহীন কিছু নেই। তিনি বান্দার জন্য তার বিধানকে সাজিয়েছেন চমকপ্রদভাবে। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ যে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সবকিছু পরিষ্কার বর্ণনা করে দিতে চান, তোমাদের পূর্ববর্তীদের পথপ্রদর্শন করাতে চান এবং তোমাদের ক্ষমা করতে চান। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ - (সুরা আন-নিসা : ২৬)।

আল্লাহ প্রদত্ত ইসলাম ধর্মের ভিত্তি হলো পাঁচটি। হাদিস শরিফের ভাষায়, ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ইসলামকে পাঁচটি ভিত্তির ওপর স্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও রাসুল- এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া। নামাজ কায়েম করা। জাকাত প্রদান করা। হজ করা। রমজান মাসের রোজা রাখা’-(বোখাির ও মুসলিম)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন এই রুকনগুলোকে সাজিয়েছেন এক অপূর্ব সাজে। তার দেওয়া রুটিন কতইনা চমৎকার, অপূর্ব।

হজ

‘নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে ও নির্দিষ্ট কাজের ইচ্ছা পোষণ করার নাম হজ।’ যা ইসলামের অন্যতম রুকন। যাকে মহান আল্লাহ তা’য়ালা শারীরিক ও আর্থিক স্বাবলম্বীদের প্রতি গোটা জীবনে মাত্র একবার আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহতায়ালার অমোঘ ঘোষণা, ‘আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছানোর’-(সুরা আল-ইমরান : ৯৭)। শুধু শারীরিক সামর্থ থাকলে অথবা শুধু আর্থিক সামর্থ থাকলে হজ ফরজ হবে না। বরং উভয় পর্যায়ের সক্ষমতা থাকতে হবে। হজ প্রতিবছর আদায় করা ফরজ নয়। জীবনে (প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর) একবার আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিচ্ছিলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে লোকসকল! আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের ওপর হজকে ফরজ করে দিয়েছেন। তোমরা হজ আদায় কর।’ তখন এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! প্রতি বছর কি হজ আদায় করতে হবে?’ রাসুল (সা.) চুপ রইলেন। ওই ব্যক্তি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করলেন। অতপর, রাসুল (সা.) বললেন, ‘যদি আমি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা তোমাদের ওপর প্রতি বছর আবশ্যক হয়ে যেত। কিন্তু তোমরা সক্ষম হতে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হজ জীবনে একবার আদায় করা ফরজ, প্রতি বছর আদায় করা ফরজ নয়।

জাকাত

‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত মালের একাংশ হাশেমি ও তাদের দাস-দাসী ব্যতীত অন্য দরিদ্র মুসলিমকে বিনা স্বার্থে প্রদান করার নাম জাকাত।’ এটি ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদের একটি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন’ -(সুরা আল বাক্বারা : ১১০)। যারা জাকাত ফরজ হওয়ার পর জাকাত প্রদান করবে না, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থাকবে। কিয়ামতের দিন তাদের সম্পদ সাপ-বিচ্ছু হয়ে তাদের ছোবল দিতে থাকবে। মুশরিকদেরও কঠোর বাণী শুনানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মুশরিকদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ। যারা জাকাত দেয় না এবং পরকালকে অস্বীকার করে’ -(সুরা হা-মীম : ০৭)। জাকাত ধনীদের সম্পদে গরিবদের নির্দিষ্ট একটি অংশ। সুদ ও শোষণমুক্ত ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকরণে জাকাতের ভ‚মিকা অগ্রগণ্য। জাকাত প্রদানকারীদের পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামাজ কায়েম করেছে এবং জাকাত দান করেছে, তাদের পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না’ -(সুরা আল বাক্বারা : ২৭৭)।

সাওম বা রোজা

‘সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্ঠির লক্ষ্যে পানাহার, স্ত্রী সম্ভোগ ও যৌনকর্ম হতে বিরত থাকার নাম রোজা’। ইসলামের অন্যতম ভিত্তি এটি। এটা নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব প্রাপ্তবয়স্ক সবার ওপর আবশ্যক। শুধু অক্ষম এবং মুসাফির ব্যক্তিগণ পরবর্তীতে তা কাযা করে নেওয়ার মাধ্যমে রমজানের রোজা ছাড়তে পারে। আল্লাহ তা’য়ালার বাণী, ‘অতপর তোমাদের মধ্যে যে অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে’ -(সুরা আল বাক্বারা : ১৮৪)। আর আল্লাহ তার এ বিধানকে বছরে অর্থাৎ বারো মাসে এক মাস পালন করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর বেশি আবশ্যক করে দেননি; যাতে বান্দার জন্য কষ্টকর না হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস হলো সেই মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে পবিত্র কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে’- (সুরা আল বাক্বারা : ১৮৫)। মোটকথা আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার প্রতি বারো মাসে একমাস রোজা আবশ্যক করে দিয়েছেন।

সালাত বা নামাজ

‘নির্দিষ্ট শর্তসমূহ পূরণ করে বিশেষ ধরনের জিকির ও রুকন আদায় করাকে সালাত বলে।’ হাদিস শরীফের ভাষায়, ‘নামাজ মুমিনদের মিরাজ; যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ পাকের সঙ্গে কথোপকথন করে।’ নামাজের প্রতি আদেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’-(সুরা আন নুর : ৫৬)। এই নামাজকে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন বান্দার জন্য প্রতিদিনের রুটিন করে দিয়েছেন। বান্দা প্রতিদিনই তা আদায় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা মুসলমানদের ওপর আবশ্যক’ -(সুরা আন নিসা : ১০৩)। এই নামাজকে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন সাজিয়েছেন অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে। সপ্তাহে একদিন মুসলমানদের মিলনমেলা তৈরি করে দিয়েছেন নামাজের মাধ্যমে। সপ্তাহের শুক্রবার সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে বান্দাকে প্রদান করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝো’- (সুরা আল জুমআ : ০৯)। অর্থাৎ সপ্তাহের একদিনকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন নামাজের মাধ্যমে। তাছাড়া দিনে-রাতে পাঁচবার বান্দাকে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে হয়। রাতের শেষ আর দিনের শুরু হয় নামাজের মাধ্যমে। আবার দিনের শেষ এবং রাতের শুরু হয় নামাজের মাধ্যমে। এই দুই ওয়াক্ত নামাজ হলো ফজর এবং মাগরিব। আল্লাহর বাণী, ‘আর দিনের দুই প্রান্তেই নামাজ ঠিক রাখবে’ -(সুরা হুদ : ১১৪)। দিনের মধ্যভাগ এবং রাতের প্রথম প্রহরে আল্লাহ তা’য়ালার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালা আদেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম করুন’ -(সুরা আল ইসরা : ৭৮)। বস্তুত এখানে জোহর ও এশার নামাজের ইঙ্গিত বহন করে। অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন বলেন, ‘আর দিনের দুই প্রান্তেই নামাজ ঠিক রাখবে এবং রাতের প্রান্তভাগে’-(সুরা হুদ : ১১৪)। এখানে শেষাংশে এশার নামাজের ইঙ্গিত বহন করে। দিনের শেষ ভাগের অগ্রবর্তী সময়ে আল্লাহকে স্মরণ করার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে’ -(সুরা আল বাক্বারা : ২৩৮)। এখানে মধ্যবর্তী নামাজ দ্বারা ফজর, জোহর এবং মাগরিব, এশা এই চার ওয়াক্তের মধ্যবর্তী আসরের নামাজকে বুঝানো হয়েছে। হাদিস শরীফের ভাষায়, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, উস্তা তথা মধ্যবর্তী নামাজ হলো আসরের নামাজ’-(তিরমিজি)। মোটকথা, আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন তার দেওয়া এ বিধানকে প্রতিদিন পাঁচবার আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং সপ্তাহে একদিন বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে জমায়েতের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

ইসলাম বা ইমান

‘মহানবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে যা কিছু নিয়ে আবিভর্‚ত হয়েছেন সবকিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ও স্বীকৃতি দেওয়াকে ইমান বলে’। যা সব রুকন সমূহের মূল। বান্দাকে সর্বদা ইমানের মধ্যে থাকতে হবে। ইমান থেকে বের হয়ে গেলে তার সব আমলই ব্যর্থ। এটাই হলো তার সব আমলের মূল। ইমান না থাকলে তার কোনো আমলই কিয়ামতের দিন কাজে আসবে না। তাই ইমান বান্দার সঙ্গে সর্বদা বিরাজমান থাকতে হবে। কখনো ইমানচ্যুত হওয়া যাবে না।

সর্বোপরি এটা বলা যায় যে, মহান আল্লাহতায়ালা তার বান্দার প্রতি ইসলামের যে রুকনসমূহকে সাজিয়েছেন তা অত্যন্ত চমকপ্রদ। প্রথমত, ইমানকে বান্দার সঙ্গে সর্বদা বহাল রাখার মাধ্যমে মুসলমান ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, অন্যতম রুকন নামাজকে দিনে এবং রাতে পাঁচবার এবং সপ্তাহে এক দিন বিশেষভাবে আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তৃতীয়ত, রোজাকে এক বছর তথা বারো মাসে এক মাস আদায় করার হুকুম দিয়েছেন। চতুর্থত, জাকাতকে বছরে একবার আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। পঞ্চমত, হজকে পুরো জীবনে একবার পালনের আদেশ দিয়েছেন। তিনি কতইনা মহান, প্রজ্ঞাময় এবং করুনাময়। আমরা যেন আল্লাহর দেয়া বিধিবিধানসমূহ যথাযথভাবে পালন করতে পারি। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist