বিষ্ণু প্রিয় দীপ

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস

প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্গত সংস্কৃত ভাষা থেকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে বাংলা ভাষা জন্ম লাভ করে। অন্যদিকে পৃথিবীর বর্তমান আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজির উদ্ভব ঘটে জমনিক ভাষা থেকে আজ থেকে সাড়ে ১৩০০ বছর আগে। বাংলার চেয়ে মাত্র ৩০০ বছরের জ্যেষ্ঠ ইংরেজি ভাষা পৃথিবীতে এখন প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। তবে ১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো বাংলাদেশের গৌরবগাথা একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারা তাদের সদস্যভুক্ত ১৮৮টি সদস্য দেশকেই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে প্রতি বছর উদযাপনের জন্য অনুরোধ জানান। এ স্বীকৃতি বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা গৌরবের ভাষায় পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি করেছে বিরল ও নতুন ইতিহাস।

আমার প্রিয় জননী জন্মভূমিতে ৪৭-এর দেশভাগ, ৪৯ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ৫২ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৬৬ ছয় দফা, ৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ঐতিহাসিক এসব ঘটনা কোনোটিই আমার প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়নি। আমার স্মৃতির ক্যানভাসে জমা নেইÑএসব ঘটনার ব্যথা, বেদনা ও গৌরবের স্মৃতি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকালে পূর্বসূরিদের মহান ত্যাগ ও মহান অর্জনের ইতিহাস জেনেছি। জেনেছি তাদের আন্দোলন সংগ্রামের অনবদ্য নেতৃত্বের উপাখ্যান। এ কারণে দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং দিবসের প্রকৃত ইতিহাস জানার আগ্রহ জাগে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমাকে দিন-রাত তাড়িত করে। বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা। আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এ দেশের মানুষের কাছে এক অনন্য প্রেরণা, আলোকবর্তিকা।

জীবন উৎসর্গ করে মুখের ভাষা ব্যবহারের দাবি আদায়ে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি কী করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেল তা জানার ইচ্ছা থেকেই জেনেছি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে রাজপথে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের রক্তদান এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের ইতিহাস। জেনেছি কানাডার ভ্যানকুভারে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক রফিকুল ইসলাম ১৯৯৭ সালের শেষদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লিখে বলেন, ‘বিশ্বের বহুভাষা ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। বহু দেশে মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে মাতৃভাষার জন্য দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম ও জীবন উৎসর্গ করে উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি পৃথিবীর ভাষাগুলোর রক্ষা, বিকাশ এবং ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এসব ইতিহাসকে স্মরণ রাখার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার দাবি জানান।’ ১৯৯৮ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা চিঠি উত্তরে জানান, প্রস্তাবটি আসতে হবে জাতিসংঘের কোনো সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। উত্তর পেয়ে রফিকুল ইসলাম ভ্যানকুভারে বসবাসকারী অন্যান্য দেশের ও ভাষার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবারো জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আগের মতোই প্রস্তাব পাঠান। জাতিসংঘের মহাসচিবের অফিস থেকে এবার জানানো হয়, এটি পাঠাতে হবে জাতিসংঘের শিক্ষার ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর প্রধান কার্যালয় প্যারিসে। তার কথামতো আরেকটি চিঠি পাঠান ১৯৯৯ সালে প্রথমদিকে প্যারিসের ইউনেসকোর সদর দফতরে। চিঠি পেয়েই সেখানকার ভাষা বিভাগে প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট আন্না মারিয়া মাজলন ৩ মার্চ উত্তরে জানান এটি একটি আকর্ষণীয় ও চমৎকার প্রস্তাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত আগ্রহে ইউনেসকো নির্বাহী বোর্ডে ১৫৭তম অধিবেশনে যোগ দেন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার দাবি সে অধিবেশনে উঠবে বলে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. এ এস এইচ কে সাদেক, প্যারিসে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, ইউনেসকোর মহাপরিচালকের উপদেষ্টা তোজাম্মেল হক রফিকুল ইসলামকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ১৬ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে বিকেলে ইউনেসকোর পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে পাস হয়। সৃষ্টি হয় বিশ্বে এক বিরল ও নতুন ইতিহাস। ভাষার জন্য আত্ম উৎসর্গের একুশে ফেব্রুয়ারিকে করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

লেখক : কলামিস্ট ও আয়কর উপদেষ্টা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist