মোহাম্মদ আবু নোমান

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

শিক্ষায় বিশ্ব রেকর্ড

আজব দেশ! লজ্জাহীন বেহায়া জনগণ আমরা! তাবৎ হুঙ্কার, ভবিষ্যদ্বাণী, কঠোর ব্যবস্থা, সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আগাম ঘোষণা দিয়ে, একটানা একের পর এক ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্ন ফাঁসের মহড়া চলছে চলমান এসএসসি পরীক্ষায়। শিক্ষাব্যবস্থা এক অভিশপ্ত অধ্যায়ে ধাবমান আজকের প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্ন ফাঁসের মহামারীতে আক্রান্ত সর্বস্তরের পাবলিক ও নিয়োগ পরীক্ষা। এত কিছুর পরও কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না, আমরা বিশ্ব রেকর্ড করেই ফেলেছি! প্রশ্ন ফাঁসে প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীতভাবে আমরা বিশ্বসেরা এতে কারো মনে কোনো প্রশ্ন, সন্দেহ, সংশয় বা খটকা আছে কি? নোবেলের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেল, গিনেসের স্যার হিউজ আজ বেঁচে থাকলে এত কিছুর পরও বর্তমান কমিটি এভাবে জেগে ঘুমাতে পারতেন কি? লম্বা জিহŸা, নখ, চুল, গোঁফ, নারীদের বিকিনি পরা, পানির নিচে বিয়ে, কত সাধারণ বিষয় নিয়েও বিশ্ব রেকর্ড হয়ে আছে। তাহলে আর কতদূর যেতে পারলে আমরা নোবেলে, গিনেস বুকে নাম লেখাতে পারব!

ভয়ংকর ক্ষমতালোভী, অহিংস নেত্রীখ্যাত, ভÐ, বহুরূপী, ধাপ্পাবাজ, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতীক তকমাখ্যাত বার্মার ‘সুচি’ গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তার করেও যদি নোবেল পুরস্কার বহন ও ধারণ করে থাকতে পারে তাহলে আমাদের আরো কতদূর কী করতে হবে? আমরা ক্লাস ওয়ান-টু থেকে স্কুল, কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা, ইউনিভার্সিটি ও মেডিক্যালে ভর্তির পরীক্ষা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছি। আমাদের এই রেকর্ড চির অক্ষয়, অমর ও অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকবে। মহাজাগতিকের কারো বাপ-দাদা, নানা-নাতির সাধ্য আছে কি এই রেকর্ড ভঙ্গের?

এর আগে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার যারা চান্স পেয়েছে তাদের বেশির ভাগই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে এরা কেমন ডাক্তার হবে, কী চিকিৎসা দেবে এবং এদের হাতে রোগীরা কতটা নিরাপদ থাকবে এমনতরো হাজারো প্রশ্ন আজ জাতির মাথায় চেপে বসেছে। এই জন্যই কি দেশের নেতা, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ীরা বাইরের দেশে চিকিৎসা নিতে যান? কারণ তারা তো চিকিৎসাব্যবস্থার বাস্তবতা, প্রশ্ন ফাঁসের গুপ্ত তথ্য ভর্তিবাণিজ্যের খবর ভালো করেই জানেন। জীবন-মরণ সমস্যাটা তো তাদের না। তারা তো এই দেশের চিকিৎসাসেবা নেন না। তাদের তো ঠাÐা, পেটব্যথা হলেই চিকিৎসার নামে ভ্রমণে চলে যান ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আমেরিকায়...। আগে আমরা পড়েছি ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল, এখন আমাদের জানতে হবেÑডাক্তার দেখার পরই রোগী মারা গেল।

জনৈক শিক্ষার্থী বলেন, বিদেশের ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে গেলে মনে হয় এটা গোরস্তান। পিনপতন নীরবতায় সবাই যার যার পড়াশোনায় ব্যস্ত। আর আমাদের দেশের ভার্সিটিতে সন্ধ্যার পর মেয়েরা কেন হলের বাইরে থাকতে পারবে না এর প্রতিবাদে মিছিলও করে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করা নুরুন্নাহার নূপুর বলেছিলেন, আফ্রিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় লেখা আছেÑ‘একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য বোমা মারার দরকার নেই, শিক্ষার্থীদের নকল করতে দাও’। তাহলে এ শিক্ষায় যেসব চিকিৎসক বের হবে, তারা রোগী মারবে, অপারেশনের সময় ছুরি, কাঁচি, গজ, ব্যান্ডেজ পেটে রেখেই সেলাই করবে, উৎকোচের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ সাজেস্ট করবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ নার্স কি ডাক্তারি পেশায় এদের জন্মই তো অবৈধ উপায়ে। প্রকৌশলীরা যা বানাবে তা ভুল হবে, ধসে পড়বে। প্রশাসনিক কর্তারা ঘুষ খাবে। ব্যবসায়ীরা খাদ্য উৎপাদনে ভেজাল করবে। দেশে এ রকম জালিয়াতির কোনোটারই কমতি, ঘাটতি বা অভাব আছে কি?

এক তথ্যে ২০১২ সালের পর থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত ৮০ বার (পত্রের) প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদনে গত ৪ বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় ৬৩টি বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে, একই সময়ে ৩০টিরও বেশি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এত গত কয়েক বছরে প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড সম্পন্ন হয়েছে।

পৃথিবীর অন্য কোথাও কি ইন্টারনেট নেই। সেখানে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না। আমরা কি মগের মুল্লুকে বাস করছি? এ প্রজন্ম যেদিন বড় হবেÑএ দেশের মাটি কামড়িয়ে ধরবে, বুক চিড়ে রক্ত পান করবে, তারপর শান্ত হবে। আমরা দেখেছি পহেলা বৈশাখের নৃশংসতা, রাজন ও বিশ্বজিৎ হত্যার হিংস্রতা; ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন, আর দেখছি পরীক্ষার আগের রাতে স্বপ্নভঙ্গের হাতাশার ঘৃণিত ব্যবসাÑপ্রশ্ন ফাঁস, আরো কত কী...।

ভুলে গেলে চলবে না, একটা দেশের উন্নতি সুন্দরবনকে ভোট দেওয়া, জাতীয় সংগীত গাওয়া, বড় পতাকা বানানো কিংবা ক্রিকেট খেলা নিয়ে নাচানাচি করার ওপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার ওপর। প্রশ্ন ফাঁস রোধে পরীক্ষা পদ্ধতি পল্টানোর বিভিন্ন পরামর্শ আসছে। পদ্ধতি যতটাই বদলানো হোক কিংবা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নির্ধারণ হোক, ভেতরেই তো ফাঁসকারী লোকদের বসবাস। তারা যতক্ষণ শোধরাবে না, ততক্ষণ ফাঁস ঠেকানো অসম্ভব।

প্রশ্ন ফাঁস রোধে পুলিশ ও র‌্যাব এখন শিকড়, গোড়া, ডাল-পালা বাদ দিয়ে পাতায় পাতায় অভিযান চালিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। প্রশ্ন কোথা থেকে ফাঁস হচ্ছে তার উৎস চিহ্নিত না করতে পেরে মোবাইলে বহনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ যত সুবিধা আছে তার কার্যকারিতা ভোগ করতে পারা সবার অধিকার। ব্যাপারটা এমন, এসব ছাত্র চেয়েছে বলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে? বা প্রশ্ন ফাঁস না হলে এরা পরীক্ষায় অংশ নিত না?

আমাদের পরীক্ষাব্যবস্থাটাকে যেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে এক গোলকধাঁধার অভ্যন্তরে, যেখান থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত যেন আমাদের কোনো মুক্তি নেই। আর এই ভেজাল এবং গোঁজামিল ব্যবস্থা দিয়ে ডিজিটাল যুগের সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়। অব্যবস্থার ব্যবস্থা দিয়ে সংকট মোকাবিলা করা যায় না। বিষয়টি মনে রাখা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist