reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

কথোপকথন : ভাষাসৈনিক এবং আমি

আলহাজ একামত আলী তালুকদার। একজন আলোকিত মনের মানুষ। যিনি সুশিক্ষার মুঠি মুঠি আলো বিলিয়ে সারাজীবন প্রশান্তি খুঁজেছেন। স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে রয়েছে তার গৌরবদীপ্ত পরিচিতি। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন গুণী শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক। মাতৃভ‚মি এবং মাতৃভাষার প্রতি তার মমত্ববোধ অসাধারণ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।

ভাষা আন্দোলনে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী আলহাজ একামত আলী তালুকদারের জন্ম টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার লোকেরপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম আহম্মদ আলী তালুকদার। গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। এনজিওতে চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হলেও সারাজীবন কাটিয়েছেন শিক্ষকতা করে। ভ‚ঞাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে টানা ৩২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। নিজ গ্রামকে নিয়ে গর্ব করতে যারা ভালোবাসেন তাদের একজন একামত আলী তালুকদার। অনেক সরকারি চাকরির সুযোগ পেয়েও শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তিনি গ্রামেই থেকে গেছেন।

প্রশ্ন : আপনি কোথা থেকে ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?

উত্তর : একজন বাংলাভাষী মানুষ হিসেবে ভাষা আন্দোলনে শরিক হওয়া উচিত এ ভাবনা আমাকে দিবারাত্রি তাড়িত করে। আমরা তো আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষের মধ্যে আল্লাহ এমন একটি গুণ দিয়েছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টির মধ্যে নেই। সে গুণই আমাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সোচ্চার করে তোলে। আত্মার ডাকেই আমি মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য বুক পেতে দিই, পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের পেছনে কোন উৎসাহ কাজ করেছে?

উত্তর : ভাষা আন্দোলনে যখন অংশগ্রহণ করি তখন মাতৃভাষার প্রতি টানেই করি। পরে ভাষা আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছে তারা ইসলামবিরোধী কাজ করেছে এমন অভিযোগ শুনতে পাই। অভিযোগের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, পবিত্র কোরআনে সুরা ইব্রাহীমের ৪ নম্বর আয়াতসহ অনেক জায়গায় মাতৃভাষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই বলা যায় ধর্মই আমাকে ভাষা আন্দোলনে উৎসাহ দিয়েছে।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতার সম্পর্ক কী?

উত্তর : ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতার প্রসূতি, যা পুরো জাতিকে এক প্লাটফরমে দাঁড় করিয়েছিল। সেই আন্দোলনে স্বাধীনতার সূর্য টগবগ করে দেখা দেয়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই দেশে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বাধীনতার চেতনা দানা বেঁধে ওঠে। ৭১-এ বাংলার দামাল ছেলেরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাস মরণপণ লড়ায়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। সে কারণে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতার নিবিড় সম্পর্ক।

প্রশ্ন : বিভিন্ন নামফলক, ভবন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নামকরণ করা হচ্ছে ইংরেজিতে। তাহলে আমরা ভাষা শহীদের মর্যাদা রাখতে পারছি কি?

উত্তর : বায়ান্নর পর একসময় ইংরেজির বদলে বাংলা ভাষায় নামফলক, ভবন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে নাম লেখার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আবার ইংরেজি ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে, যা দুঃখজনক। এটা ভাষা শহীদের অবমাননা প্রদর্শন।

প্রশ্ন : এখনো অনেক জায়গায় বাংলা সনের প্রচলন নেই। বিষয়টি আপনি কী মনে করেন?

উত্তর : এটা দুঃখজনক। আমাদের দেশে শহরে ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে বাংলা সনের প্রচলন নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষাকে আরো কীভাবে সমৃদ্ধ করা য়ায়?

উত্তর : পৃথিবীর সব ভাষার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেÑএমন সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ দান করতে হবে।

প্রশ্ন : ১৯৯৬ সালের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান দাবি করেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি তিনি প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। আপনিই তো একই দাবি করেন। কোনটা সত্য?

উত্তর : ২০ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ভাষা আন্দোলনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি ছিল ২১ ফেব্রæয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার পরামর্শ সভা। পরের দিন ২১ ফেব্রæয়ারি গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলার এক সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণা মোতাবেক আমি সর্বপ্রথম পুলিশের বাধা অতিক্রম করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি। সেখানে হাবিবুর রহমান ছিলেন না।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর কেটে যাচ্ছে পেছনের দিকে, এতে আপনার কী মনে হয়?

উত্তর : বয়সের ভারে ন্যুব্জ একামত আলী তালুকদার স্মৃতির পাতা আগলে বলেন পেছনের দিকে তাকালে বায়ান্নর সেই স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা। ২১ ফেব্রæয়ারি আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করলাম। সর্বপ্রথম আমি উন্মাদের মতো দৌড় দিলাম ১৪৪ ধারা ভাঙতে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলাম। আমার পিছে পিছে যারা এসেছিল সবাই গ্রেফতার হলো। আমাদের একটি গাড়িতে করে তেজগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ঢাকার অন্য এলাকা থেকেও ছাত্রদের গ্রেফতার করে আমাদের সঙ্গে রাখা হলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২১ জনকে বন্দি করা হলো তেজগাঁও থানায়। এখনো ভাষা আন্দোলনের সেসব ঘটনা স্মৃতি হয়ে আছে।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের আর কী মনে পড়ে?

উত্তর : অনেক কিছুই তো মনে আছে। তেজগাঁও থানা থেকে ২২ ফেব্রæয়ারি আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। দুই দিন আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সহপাঠীদের খবর জানার জন্য। কারণ আমাদের মনের আশঙ্কা ছিল কেউ মরল কি না? অবশেষে কারাগারে গায়েবানা জানাজা করা হলো। শুনলাম ছাত্রদের ওপর গুলি হয়েছে। অনেক ছাত্র নিহত ও আহত হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনার এলাকায় কি ভাষা আন্দোলন হয়েছিল?

উত্তর : ২১ দিন পর নিঃশর্ত মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে শুনলাম, যেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যালে পড়তে এসেছে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন কান্নাকাটি করছে। এ অবস্থায় বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে শুনি ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশ ঐক্যবদ্ধ। শুনলাম আমাদের শিয়ালকোল হাট থেকেও এলাকার সচেতন মানুষ চাঁদা তুলেছে, বন্দি ভাষাসৈনিকদের মুক্ত করার জন্য এবং কারাগারে তাদের জন্য খাদ্য পাঠাতে। জানতে পারলাম আমাদের এলাকায়ও সেøাগান হয়েছে ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

প্রশ্ন : আমাদের সংবিধানে লেখা আছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে?

উত্তর : কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে এ বিষয়ে যারা বিজ্ঞ তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষার পাঠ্যবই বাংলায় রচনা করতে হবে।

প্রশ্ন : সর্বস্তরে বাংলা চালু করার সরকারি উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে?

উত্তর : সরকারি নথিপত্রে বাংলা লেখতে পরিপত্র জারির কথা শুনেছি। সে যাই হোক শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা মাধ্যম প্রবর্তন হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়েছি।

প্রশ্ন : গণমাধ্যমে ইংরেজি, হিন্দি ভাষা মিশ্রণ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে বেসরকারি রেডিওতে ভাষা ব্যবহারে অরাজকতা চলছে। নিরসনের উপায় কী?

উত্তর : শুনেছি এফএম রেডিওতে ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলার মিশেলে এক ধরনের জগাখিচুরি সৃষ্টি করে, এটা দুঃখজনক। আর ২০০ বছর ইংরেজি শাসনে আমাদের দেশ থাকায় অনেকে এখনো দুটো কথা ইংরেজিতে বলতে গর্ববোধ করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় গণমাধ্যমে এ অরাজকতা কঠোর হস্তে দমন করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষার গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি। সেই লক্ষ্যে তারা কতটা স্থির আছে?

উত্তর : বাংলা একাডেমি এখনো পুরোপুরি গবেষণার ক্ষেত্র পরিণত হয়েছে তা বাংলা ভাষাবিদরা স্বীকার করেন না। তবে তারা লক্ষ্যচ্যুত হননি। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষাবিদদের বক্তব্য শুনলে আমাদের হতাশ হতে হয়। আশার জায়গা কোথায়?

উত্তর : অনেকে হতাশা প্রকাশ করলেও আসলে পুরোপুরি বিষয়টা হতাশাজনক নয়। গত ৬৬ বছরে বাংলা সাহিত্যের পরিধি অনেক বেড়েছে।

প্রশ্ন : আপনি ভাষাসৈনিক হিসেবে কোনো সম্মাননা বা পুরস্কার পেয়েছেন কি?

উত্তর : ভাষাসৈনিক হিসেবে সম্মাননা বা পুরস্কার পাইনি। এজন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াই বড় প্রাপ্তি। আর কিছু চাই না। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি রাখতে চাই সব ভাষাসৈনিককে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হোক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে আনোয়ার হোসেন বকুল

সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist