রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

ইরান সংকটে ফায়দা কার

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরান। দিন দিন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর তা ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে। আর শুধু ক্ষোভ-বিক্ষোভই নয়, এর সঙ্গে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও। দেশটির সরকারের হুশিয়ারির পরও নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে বহু লোক নিহত হয়েছে বলে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। সংঘর্ষে ঘটেছে আহত হওয়ার ঘটনাও। এ ছাড়া ইরানের রাজধানী তেহরানে অনেককে গ্রেফতার করার ঘটনাও ঘটেছে। যাদের বিক্ষোভকালে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, নানা সময়ই সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার খবর সামনে আসে, যা কোনোভাবেই ইতিবাচক হতে পারে না। আর এটা আমলে নেওয়া দরকার যে, সহিংসতার খবর যেমন সামনে আসে, তেমনি কোথাও কোথাও নৃশংস হামলা বা ভয়ংকর পরিস্থিতির চিত্রও পরিলক্ষিত হয়, যা সার্বিকভাবে মানুষের জীবনযাপনের জন্য সুখকর নয়। পৃথিবীর এই ভয়ানক বাস্তবতার অবসান না ঘটাতে পারলে মানুষ তার বসবাসের স্বাভাবিকতা হারাবে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এ ছাড়া যখন ক্ষোভ-বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার খবরও সামনে আসছে, তখন তা যেমন আমলে নিতে হবে, তেমনি বিশ্ব নেতৃত্বকে পুরো বিশ্বের যে সামগ্রিক অস্থিরতাÑতা অনুধাবন করে সংকট নিরসনে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হতে হবে।

অন্যদিকে মার্কিন-ইসরাইল নীতির বিরুদ্ধে ইরানের ভূমিকা পূর্বাপর স্পষ্ট। ইরানের আরবনীতিও উম্মাহপ্রীতির মতো বিঘোষিত। তাই ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। জনগণও জানে, ইরানের শত্রু ও মিত্র কারা। জনগণকে শত্রু বন্ধু চিনিয়ে দেওয়া ইরানের নেতৃত্বের বড় একটা কৃতিত্ব। তাই কিছু নীতিগত বিরোধ নিয়েও ইরানের জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আলেমসমাজ একই সমতলে অবস্থান করে এক ধরনের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। এবার যে আন্দোলন হলো, তার সঙ্গে কিছু লোকের দ্রোহ থাকতে পারে। একটি খ-িত অংশ হিসেবে তারুণ্যের শেকল ভাঙার অনৈতিক উচ্ছ্বাসও থাকতে পারে। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে হোক আর অপ্রকাশ্যেই হোক, ইরানের নেতৃত্ব ও জনগণ একাট্টা হয়ে মোকাবিলা করে। ইসরাইলি হুমকি মোকাবিলায়ও ইরানের জনগণ কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে না। এটা স্বীকার করা উচিত, এবার সত্যি সত্যিই ইরানি জনগণের একটা অংশ পণ্যমূল্যসহ কিছু অভ্যন্তরীণ কারণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে যাচ্ছিল। নেতৃত্বহীন এই ক্ষোভ দমনের মুখে পড়েছে এটা ঠিক, এর সঙ্গে যখন আমেরিকা ও ইহুদি লবির উসকানি স্পষ্ট হলো, তখনই জনগণ প্রবোধ মানল এবং পাশ্চাত্য প্রচারণায় দিকভ্রান্ত হলো না। তাই যারা কিছু সংকট চিহ্নিত করে আন্দোলনে নেমেছিল তারা সরাসরি চিহ্নিত হয়েছে আমেরিকা ইসরাইলের ক্রীড়নক। যারা চেয়েছিল একটি প্রতিবাদ হোক, তারাও উসকানির কারণে মত পাল্টিয়েছে। ইরানি জনগণ কয়েকটি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিও ফ্রে হুন তার সব অভিমতের সঙ্গে একমত হওয়ার দায় নেই কারো। তবে পশ্চিমা শক্তি ইরানকে এই মুহূর্তে কীভাবে দেখছে, তা বোঝার জন্য এ মন্তব্য বিবেচনার দাবি রাখে। তবে এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক মহল সব সময় ইরানের প্রযুক্তির ভেতরও রক্ষণ শীলতা দেখে। বাস্তবে ইরান আদর্শিক ভাবনায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। তাই ইরান শুধু পররাষ্ট্রনীতিনির্ভর রাষ্ট্র নয়। তবে এ বিবেচনা মাথায় রেখেই বলা যায়, ইরান সম্ভবত অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে আরো একবার দক্ষতা দেখাতে পেরেছে। বিপ্লবের পর ইরান অনেকবার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যেমন নাশকতা, যুদ্ধ চাপানো, অবরোধ, গোয়েন্দা তৎপরতা; কিন্তু এর নেতৃত্বের আদর্শিক অবস্থানের দৃঢ়তা ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাই শেষ পর্যন্ত সুফল এনে দিয়েছে। ইরানি জনগণ তাদের নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারায়নি। পারস্য সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী এ দেশটি বিগত শতকের শেষ দুই দশক থেকে রাজতন্ত্রের বদলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। এটি ইরানি জনগণের বিপ্লবের পথ ধরে গৌরবময় অর্জন। এর নেতৃত্বের কাঠামো অনেকটা ব্যতিক্রম। আলেমদের অভিভাবকত্ব ইরানি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছে। তাই যতবারই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যায় পড়েছে, কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ এসেছে, ততবারই রাহবার নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করেছেন। জনগণ সেটাই মেনে নিয়েছে। ইরানি জনগণের আদর্শিক আনুগত্যের জায়গাটা এখনো অটুট রয়েছে। বোধ করি, এবারের কথিত আন্দোলন তাই নেতৃত্ব পায়নি। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এক সুরে কথা বলছে না। তাই হরেক বিশ্লেষণের মধ্য থেকে আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষত পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্বশীল বিশ্লেষণটা সামনে রাখা যায়। এক সুরে না বললেও আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, ইরানের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ আন্দোলনের অসাধারণ দিকটা হলো, এই আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন, তা সম্ভবত তাদের বিরুদ্ধেই গেল। ইরানের অতিরক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা ভেবেছিলেন, দেশটির রাজধানীতে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের বিক্ষোভ উসকে দিয়ে তারা মধ্যপন্থি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কর্তৃত্ব খাটো করবেন। কিন্তু ব্যাপারটি যদি সেটাই হয়, তাহলে বলতে হয়, বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে ইরানের মানুষের ক্ষোভটা ঠিক কোন পর্যায়ের, সেটা তারা বুঝতে পারেননি, বিশেষ করে সেখানে তাদের ভূমিকা কী। প্রতিবাদ আন্দোলন যত বড়ই হোক না কেন, তাতে সরকারের পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী খুবই শক্তিশালী, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের অংশীদারিত্বও কম নয়। তারা ইরানের অর্থনীতির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের নেতা নেই, নেই পরিষ্কার উদ্দেশ্য। পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের যতই উৎসাহ দিক না কেন, এটা পরিষ্কার, আর যা-ই ঘটুক না কেন, ইসলামপন্থিরা ক্ষমতার ভিত্তি ধরে রাখবে এবং নিরাপত্তা কার্যক্রমের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে। উদাহরণস্বরূপ এটাও হতে পারে যে, রুহানি হয়তো শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক পদত্যাগ করবেন। কিন্তু প্রতিবাদকারীদের কাছে এটা তেমন একটা সফলতা হিসেবে বিবেচ্য হবে না। সর্বোপরি রুহানি সম্ভবত একজন মধ্যপন্থি প্রশাসক হিসেবে পরিচিত। রুহানি পদত্যাগ করুন আর না-ই করুন, এটা এখন পরিষ্কার যে, এই পরিস্থিতি চিরকাল চলতে পারে না। সম্ভবত খুব বেশি দিন তা চলবেও না।

ইরানিদের বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালে যে পারমাণবিক চুক্তি করা হয়েছিল, সেটা তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বের করে আনবে। কিন্তু ধারাবাহিক অনেক কিছু ঘটে গেল, তাদের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং তরুণদের বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে ইরানের স্থান নিচের দিকে। রুহানি এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ইরানে সংস্কার শুরু করেননি বা তা করতে অপারগ। কিন্তু এই প্রতিবাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উত্তরণে তিনি আগের চেয়ে বেশি উৎসাহী। তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আরো শক্তিশালী নেতৃত্বে ও পরিষ্কার লক্ষ্যে ইরানে দীর্ঘকাল প্রতিবাদ হতে পারে। ইরানের অর্থনৈতিক সংস্কারের আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দেশটির সম্প্রসারণ শীল পররাষ্ট্রনীতি অযৌক্তিকভাবে ব্যয়বহুল। ইয়েমেনে প্রক্সি যুদ্ধ চালানো, লেবাননে রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী তৈরি এবং সিরিয়া ও ইরাকে আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে বছরে শত শত কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। ইরানের এই সমস্যাজনক পররাষ্ট্রনীতি অব্যবস্থাপনার ফসল নয়, এর পেছনে অন্য কারণও আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে কীভাবে একটি গ্রহণযোগ্য উপায়ে সমাধান করা যায় সেই বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের দাবির যৌক্তিকতা পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে দেশটির সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে করণীয় নির্ধারণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এদিকে নতুন বছরে পারমাণবিক ইস্যুতে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এ উত্তেজনা মাত্রা ছাড়ালে জ্বালানি তেলের বাজার আরো তেজি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও উত্তর কোরিয়ায় গোপনে জ্বালানি তেল রফতানি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে চীন। পিয়ংইয়ং অভিমুখে জ্বালানি তেলবাহী দুটি কার্গো জাহাজ আটক করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। এ ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সব মিলে আগামী দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বিষয়াদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক হিসেবে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন হানসেন। নিউইয়র্কভিত্তিক কনসালট্যান্সি এনার্জি অ্যাসপেক্টসের পণ্যবাজার বিশ্লেষক রিচার্ড ম্যালিনসন বলেন, ইরানে চলমান বিক্ষোভ এখন পর্যন্ত তেহরানকেন্দ্রিক হলেও জ্বালানি তেলের বাজারের জন্য তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist