অলোক আচার্য

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

শিক্ষা যখন ধ্বংসের বন্ধু

পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। তার ধারাবাহিকতায় নিয়মিতভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। স্কুল পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষা সব পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক কারা এসব করছে বা কেন করছে তার ছোট ছোট কিছু কারণ এবং এর পেছনের মানুষদের পাওয়া যাচ্ছে। তবে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় যখন সর্বোচ্চ সতর্কতা সত্ত্বেও প্রতিটি পরীক্ষার পরেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে তখন দেশে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেছে। প্রতিটি পরীক্ষার পরদিনই পত্রিকার পাতায় সেই পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের খবর কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মনে ঠিক কতটা আঘাত করছে জানি না। তারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তারা ধরেই নিয়েছে কেউ কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে পরীক্ষা দেবে আবার কেউ কেউ সারা বছর লেখাপড়া করে পরীক্ষা দেবে। কারণ পরীক্ষার আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, পরীক্ষা কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ বা প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা কোনো কিছুই থামাতে পারেনি প্রশ্ন ফাঁস। কাজেই এটা ধরেই নেওয়া যায় যে, প্রশ্ন ফাঁসকারীরা প্রযুক্তিতে এবং বুদ্ধিতে অনেকটাই এগিয়ে। এবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা যার সিংহদ্বারে লেখা রয়েছেÑ কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা দালানকোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি। সাম্প্রতিক পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে একজন এই তথ্যটি মন্তব্যের ঘরে উল্লেখ করেন। পরীক্ষা নেওয়ার ব্যর্থতা সংক্রান্ত এত চমৎকার উদাহরণ আগে পাইনি। তথ্যটির সঙ্গে যদি বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিত বিবেচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে আমরা ধীরে ধীরে সেই চূড়ান্ত পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। যদিও কর্তৃপক্ষ পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কেবল এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা একটু আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার পর বিষয়টি এতটাই নগ্ন আর খোলামেলা হয়ে গেছে যে, এটা নিয়ে আর ঢাকঢাক গুড়গুড় করে কোনো লাভ নেই।

প্রযুক্তির এই অসহায় দিকটি আমাদের মেধাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আরো একটা বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তা হলো, এই ছোট ছোট শিশুরাও জেনে গেল যে, প্রশ্ন ফাঁস নামের এক ক্যানসার দেশে আছে এবং কিছু অর্থলোভী মানুষ সেই ক্যানসার সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিজেরা নিজেদের পায়ে সুপরিকল্পিতভাবে কুড়াল মারছি। কতিপয় অসাধু মেধা বিক্রেতা মেধাকে রাস্তায় নিয়ে বিক্রি করছে। রীতিমত ফেরি করে বিক্রি হয় মেধা। তার দাম হাঁকানো হয়। লাখ লাখ টাকায় তা কেনাবেচা হয়। এভাবে মেডিক্যালে চান্স পেয়ে ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কোনো ক্যাডার বা কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠা পান। যারা নিজেদের শুরুটাই দুর্নীতির মাধ্যমে করেন তারা কিভাবে শেষটা ভালোভাবে করবেন? এসব প্রশ্ন ফাঁস করে ভালো ফল করা শিক্ষর্থীরা এক দিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে বসবে। তখন সেই পদের দায়িত্ব রক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের মতো সহজ কোনো উপায় তারা পাবেন না।

প্রশ্ন ফাঁসের কারণ প্রকৃতপক্ষে একটা দুটো নয়। এর সঙ্গে রয়েছে আর্থিক যোগসূত্র এবং কিছুটা মেধাকে ধ্বংস করার নিখুঁত পরিকল্পনা। এবং একইসঙ্গে নৈতিকতাবিরোধী কাজকর্মের জন্য শিক্ষক সমাজের ওপর দুর্নাম আসছে। আসলে যারা এ ধরনের নৈতিকতাবিরোধী কাজকর্ম করছেন তাদের শিক্ষকের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ শিক্ষক হতে গেলে যে গুণাবলি অর্জন, যে মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন তা তাদের নেই। তাই পেশাগতভাবে সে শিক্ষকতা করলেও আসলে শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তাদের নেই। তাই গুটিকতক লোভী ও নীতিহীন শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ দায় নিতে পারে না। আজ শিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায় শিক্ষকরা এড়াতে পারে না। কারণ প্রশ্ন ফাঁস নামক একটি অসৎ কাজের পেছনে গুটিকতক শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার জড়িয়ে রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভালো রেজাল্ট হয়তো হচ্ছে, কিন্তু মেধার বারোটা বেজে যাচ্ছেÑযা সে বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এভাবে শুধু সে পিছিয়ে পড়ছে তা নয়, দেশটাকেও পিছিয়ে দিচ্ছে। কারণ দেশে হাজার হাজার মেধাহীন জনশক্তির চেয়ে অল্পসংখ্যক মেধাবী থাকা উত্তম। তাই শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙে যারা দেশটার অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।

নিজের পকেট ভারী করে দেশের মেধা বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করছে না এসব অকাল কুষ্মান্ডরা। মেধা দিয়ে তো আর তাদের বাড়ি গাড়ি হবে না। রেজাল্টের পাশে গোল্ডেন জিপিএ থাকবে না। তাই টাকা দিয়েই কিনতে হবে। আর প্রশ্ন ফাঁসকারীরাও এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। টাকা তো তাদের চাই-ই। তাই তো প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছে। বাজারে যারা ব্যবসা করে তাদেরও একটা নীতি আছে বলে মনে হয়। কিন্তু যারা আগেই প্রশ্ন বিক্রি করে তাদের নীতির বালাই আছে বলে মনে হয় না। দেশের মূল সম্পদ কোনটি? প্রশ্ন করলে আমার এক কথার উত্তর হবেÑ মেধাবীরা। একমাত্র মেধাবীরাই পারে দেশের বাকি সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে। জাতির মেধাকে ধ্বংস করে কোনো দিন উন্নয়ন আশা করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষভাগে এসে যখন পাকিস্তানিরা দেখল যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, তখন বেছে বেছে তারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল। যাতে স্বাধীন হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি আমরা। যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে আমরা আরো এগিয়ে যেতাম নিশ্চিত। প্রশ্ন ফাঁস করে জাতির মেধাবী সন্তানদের মেধা বিকশিত হওয়ার আগেই মেরে ফেলাটাও সে রকম জঘন্য কোনো অপরাধ বলে মনে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এটা তার থেকেও বড়। কারণ যাদের মেধা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে চৌর্যবৃত্তি করে পরীক্ষার ফল কেনা হলো, তার মেধা আর কোনোদিন বিকশিত না হওারই কথা। সে সারা জীবন এই অবস্থা থেকে বের হতে পারবে কি না সন্দেহ।

অবশ্য যারা এই অশুভ প্রক্রিয়া চালায়, তারা শুধু জেএসসি বা এসএসসি নয়; বরং চাকরির পরীক্ষাগুলোতেও একই চেষ্টা অব্যাহত রাখেÑ সে কথা বলাই বাহুল্য। একটি জাতির মেধাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এর চেয়ে আর ভালো উপায় আর কী হতে পারে? জানি না এর পেছনে কারা জড়িত আর কেনই বা আমাদের আগামী প্রজন্মকে আমরা এমন পঙ্গু করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছি। এতদিন চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমরা ধরেই নিই, কোথাও না কোথাও প্রশ্ন ফাঁস হবেই। তবে সেখান থেকে স্কুল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবেÑএ আমি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারি না। আমাদের জাতিকে এভাবে মেধাশূন্য করার পেছনে যারা কাজ করে যাচ্ছে তাদের খুব দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ছাত্রছাত্রী থাকবে, শিক্ষক থাকবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবেÑ তবে লেখাপড়া করার বা করানোর খুব বেশি দরকার হবে না। রাত জেগে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ারও দরকার হবে না। আর সেটা হলে আমরাই বড় বিপদে পড়ব।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist