মো. কায়ছার আলী

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

গুরু টেরিফক্সের কথা

যদিও ক্যানসার রোগটিকে জয় করার কথা বলি, মানুষকে সান্ত¦না দেইÑতবে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বেলায় মানতে রাজি নই। এ রোগের জয় সম্পর্কে লিখতে গেলে লিখতে হবে ক্যানসার রোগীদের গুরু-টেরিফক্সের কথা। হিরো, সুপার হিরো টেরিফক্স। হিরো শব্দটি একটি পশ্চিমা কনসেপ্ট। টেরিফক্স কানাডার ২২ বছরের এক টগবগে যুবক। এত অল্প বয়সে ভয়াবহ ক্যানসারের আক্রমণে তার এক পা কেটে ফেলে দিতে হয়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি ভাবলেন, আরো অর্থ প্রয়োজন, তিনি ঘোষণা করলেন, এক পা দিয়েই কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দৌড়ে অর্থ সংগ্রহ করবেন। আটলান্টিক সমুদ্রে এক পা ডুবিয়ে দিয়ে তিনি দৌড় শুরু করলেন। তত দিন একটি নকল পা লাগানো হয়েছে। ১৪৩ দিনে ৩৩৩১ মাইল অতিক্রম করে তাকে হারতে হলো। কারণ তত দিনে ক্যানসার ফুসফুস পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হলো। তিনি সংগ্রহ করলেন ১০০ মিলিয়ন ডলার। এখন সংগ্রহ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ২০১৩ সালে। তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার নামে ২৫তম টেরিফক্স ম্যারাথনে পৃথিবীর ৩ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। এভাবেই তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

এ দেশের সবচেয়ে শক্তিমান কলম জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ স্যারও চিরতরে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যদিও তিনি আমেরিকায় চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে তার পরিকল্পনার কথা পাঠকের উদ্দেশে লিখে গেছেন, ‘আমার পরিকল্পনা হলো তিনজন ভিক্ষুকের কাছ থেকে প্রথমে ক্যানসার রিসার্স সেন্টারের জন্য অর্থ ভিক্ষা নেওয়া হবে। এদের ছবি তুলবেন নাসের আলী মামুন। স্কেচ করবেন ও ইন্টারভিউ নেবেন মাসুদ হেলাল। তারপর আমরা যাব বাংলাদেশের তিন শীর্ষ ধনী মানুষের কাছে। ভিক্ষুকরা দান করেছে শুনে তারা লজ্জায় পড়ে কী করেন, আমার দেখার ইচ্ছা। শীর্ষ ধনী, তারপর আমরা যাব তিন রাজনীতিবিদের কাছে। তারা কিছুই দেবেন না আমরা জানি, তারা নিতে জানেন, দিতে জানেন না। তবে খালি হাতে আমাদের ফেরাবেন না। উপদেশ দেবেন, আমাদের উপদেশের তো প্রয়োজন আছে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্বর্ণ, মর্ত ও পাতাল ট্রিনিটি তিন মানে আমি, তুমি ও সে।’ এখানে স্যার ‘আমরা’ (আমি, তুমি ও সে) বলতে সম্মিলিত শক্তিকে বুঝিয়েছেন। তিনি অর্থ সংগ্রহের জন্য পথ দেখিয়েছেন। সরকার এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পক্ষেই তার স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব। বর্তমানে এই মরণব্যাধি এ দেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১৫ লাখ লোকের জন্য একটি করে রেডিও থেরাপি ইউনিট থাকা আবশ্যক। সে অনুযায়ী দেশে ১৪০-১৬০ রেডিও থেরাপি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি (১০+৭) মোট ১৭টি ইউনিট রয়েছে। ৯০০ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরিবর্তে মাত্র ১৭৫ জন এবং ৩০০ চিকিৎসা পদার্থবিদের পরিবর্তে মাত্র ২০ জন আছেন, যা একেবারেই অপ্রতুল। ক্যানসার নিরাময়ে তিন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত। শল্য সার্জারি (ঝঁৎমবৎু), কমোথেরাপি (ঈযবসড়ঃযবৎধঢ়ু) এবং বিকিরণ (জধফরড়ঃযবৎধঢ়ু)। ক্যানসারের কোষ ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করার পদ্ধতির নাম কেমো। রোগের ঝঃধমব অনুযায়ী ৬-১২ বার কেমো দেওয়া হয়। তখন রোগীর শরীরের চুল উঠে যায়, ক্ষুধামন্দা, বমিও বমির ভাব, শারীরিক দুর্বলতা, পাতলা পায়খানা হয়। দেহের কোনো অংশের অনিয়ন্ত্রিত কিংবা অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় টিউমার (ঞঁসড়ৎ) বলে। টিউমার দুই ধরনের। একÑনির্দোষ টিউমার (ইবৎরমহ), অন্যটি ক্ষতিকর টিউমার (গধষরমবহঃ)। এটি ক্যানসার বা কর্কট রোগ।

তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে গেছে আমার মনে হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা এ রোগ মোকাবিলা করে মানবজাতিকে কীভাবে দীর্ঘজীবী করা যায় তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই রোগ কী কারণে হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। যেকোনো মানুষের যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। তবে চর্বিযুক্ত খাবার, তামাকের বহুবিধ ব্যবহার, বংশগত কারণ, অনিয়ন্ত্রিত যৌন জীবন পরিত্যাগ করা ভালো। ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত বুঝতেই পারে না যে, তার এ রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। তবে কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। মলত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন, কোনো ক্ষত সহজে না সারানো, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, হজমে সমস্যা, কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়া এবং শরীরে তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট, পরিবর্তন ইত্যাদি। এগুলোর একটি দৃষ্টিগোচর হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ছোটবেলা থেকেই এ রোগটির কথা শুনেছি, দূর থেকে জেনেছি। কিন্তু নিকট আত্মীয়-স্বজন বা রক্তের সম্পর্কিতদের মধ্যে কাউকে দেখিনি। তাই রোগটি সম্পর্কে তত বেশি মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ২০১৫ সালের শেষের দিকে আমার বড় বোন ফিরোজা বানু (৪৬) হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। যিনি দিনাজপুর শহরে একটি প্রাইভেট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। পূর্ব থেকেই তার ডায়াবেটিস (১৫-২০) এবং উচ্চ রক্তচাপ (১১০-১৫০) ছিল। নিয়ম এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতেন। পারিবারিক কাজের চাপের কারণে দিনে বা রাতে পরিপূর্ণ বিশ্রামের সময় পেতেন না। কোমর এবং বুকের ব্যথা অনুভব করলে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফুসফুসে জমে থাকা পানি বের করা হয়। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা সমস্যা হলে তাকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। চোখে, পায়ে, কানেরসহ নানাবিধ সমস্যা একসঙ্গে দেখা দেয়। ২০১৬ সালে জানুয়ারি মাসে মহাখালীর আয়শা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হলে আমরা ছোট দুই ভাইসহ তাকে দেখতে যাই। তখন আপা (আমার স্ত্রীর বড় বোন) আমাদের মুখের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আমাদের গলার কণ্ঠস্বর শুনে থেমে থেমে কথা বলা শুরু করেন। সচেতন হওয়ায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিছু লোক আছেন যারা ধ্বংসের মধ্যেও সৃষ্টি করতে জানেন, এমতাবস্থায় আমাদের সান্ত¦না দিয়ে বলেন, ‘আমি হয়তো বেশি দিন বাঁচব না, তবে মাত্র দুই বছর বাঁচার বড় ইচ্ছা ছিল। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমার যা হয়েছে হোক, তোমাদের যেন না হয়, তোমরা সবাই ভালো থেকো এবং আমার জন্য দোয়া করিও।’ ডাক্তারের কাছে তার চোখের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন, তার চোখে রেটিনার সমস্যা হয়েছে, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যেতে পারে।’ ডাক্তারদের সন্দেহ হলে তারা ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য উরমহড়ংরং করলে রিপোর্ট আসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় উঁপঃধষ ঈঁৎপরহড়সর রহ ঝরঃঁ (উঈওঝ) ংঃধমব ৪, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে দ্রুত ছড়ায়। শুরু হলো কেমো দেওয়া। তখন শরীরের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা গেল। চুলগুলো খসে গেল, আঙুলের নখগুলো কালো হয় গেল, শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো নিস্তেজ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে না ফেরার দেশে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

একটু জ্ঞান ফিরলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিমানে করে দিনাজপুরে নিয়ে এসে তিন দিন পর আবার চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কেমোথেরাপির কোর্স সমাপ্ত করে সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিনাজপুরে নিয়ে আসা হলো। ২৩ সেপ্টেম্বর জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হলো। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকাল ৯টায় পৃথিবীর সোনালি উদয়, মায়া, মমতা, ভালোবাসা ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। আহ্! মনে পড়ে, যে হাত দিয়ে তিনি আমাদের পরম মমতায় আগলে রাখতেন, সে হাত আজ পড়ে আছে নরম বিছানায়। যে চোখ দিয়ে তিনি পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যকে উপভোগ করতেন এবং প্রিয় মানুষগুলোর মুখ দেখে শান্তি পেতেন সে চোখ আর খুলল না। যে পা দিয়ে কর্মঞ্চল হয়ে স্কুলের পথে রওনা হতেন এবং যে পায়ের ভরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন, সে পা আজ সমান্তরালে পড়ে আছে। সন্তান জন্মের পর প্রথম বুলি মা। আজ মা তার আদরের মেয়েকে ‘মা, মা’ বলে ডাকছে। কিন্তু নিথর দেহে চিরবিশ্রামে শায়িত মেয়ে আজ তার মাকে প্রথম বুলি ‘মা’ বলে ডাকতে পারছে না। সে মুখ আজ চিরতরে স্তব্ধ। সযতেœ বেড়ে ওঠা যে চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে রেখে তিনি হয়তোবা ফুল গুঁজিয়ে দিতেন, সে চুল আজ আর নেই। সংসারের জন্য অসীম ত্যাগ এবং সীমাহীন কষ্ট বা যন্ত্রণা নিয়ে আপার মতো এই রোগে যাদের জীবন প্রদীপ অস্তমিত হয়, তাদের সবাইকে যেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাফ করে দেন। এ প্রার্থনা করি।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist