আলমগীর খান

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

ট্রাম্পের ঐতিহাসিক নেতৃত্ব এবং...

যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ও শক্তিশালী দেশ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কারো উন্নতিই চিরস্থায়ী নয়। উন্নত অবস্থাকে ধরে রাখার জন্য প্রত্যেককে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। অর্থাৎ উন্নতি একটি চলমান ঘটনা, স্থির নয়। যুক্তরাষ্ট্রও তাই যত শক্তিশালী ও বড়ই হোক না কেন, তারও ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। মহৎ থেকে তাকে মহত্তর হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। কাজটি সহজ নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই ও পথ মাড়াননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবার মহান’ করার সেøাগান দিয়েছেন। অবশ্য সেøাগানটি রোনাল্ড রিগানের কাছ থেকে ধার করা, তার নিজস্ব নয়। আসলে দেশটিকে মহত্তর করার জ্ঞানবুদ্ধি ও ক্ষমতা কিছুই ট্রাম্পের নেই। তাই সবাইকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ‘মহান’ করার এই সেøাগান। সফলও হয়েছেন তিনি এবং সবাইকে চমকে দিয়ে প্রেসিডেন্টও হয়েছেন।

এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সোজা নিচে টেনে গর্তে নামাতে শুরু করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি নিজ দেশসহ বহু দেশের মানুষ ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের জন্য একের পর এক সমস্যা তৈরি করে চলেছেন। কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা তো তার নেই-ই, বরং নতুন নতুন সমস্যা তৈরিতে তিনি ওস্তাদ। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রসমূহ তার হাতের আঙুলের স্পর্শের অপেক্ষায় কাঁপছে। পৃথিবীব্যাপী সমস্যা ছড়িয়ে দিতে কাঁপছেন তিনিও। ধ্বংসযজ্ঞের জন্য অস্ত্রের মজুদ তার আছেই, সেই সঙ্গে আছে তার এক উত্তপ্ত জিভ, পৃথিবীর যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রকে যা হারিয়ে দিতে সক্ষম। তার মুখ থেকে এমন সব শব্দ নির্গত হয়, যা যেকোনো বিরাট দেশকে মুহূর্তে নোংরা দিতে পারে, সেই দেশের সব অধিবাসীর সারা বছরের মানববর্জ্যও যা পারে না।

ট্রাম্পের জিভ থেকে যা বেরুচ্ছে তা সবুজ পৃথিবীকে হলুদ ও দুর্গন্ধময় করে তুলছে। সম্প্রতি তিনি হাইতি, এল সালভেদর ও আফ্রিকার জাতিসমূহকে ‘শিটহোল দেশ’ বলে গালি ছুড়ছেন। ‘শিট’ আর ‘হোল’ ছাড়া ট্রাম্পের মাথায় যে আর কিছু নেই, তা এখন সবারই জানা। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, চিন্তাবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বহুদিন ধরে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তাদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘মিথ্যুক’, ‘নারীবিদ্বেষী’, ‘জাতিবিদ্বেষী’, ‘পাগল’, ‘স্বৈরাচার’ ও ‘মূর্খ’ বলছেন। আমাদের বলার কিছু নেই। অভিবাসীদের সম্পর্কে তার কটূক্তি থেকে বোঝা যায়, তিনি বহির্বিশ্ব দূরে থাকুক, নিজ দেশ সম্পর্কেও জানেন না।

ট্রাম্পের নোংরা মন্তব্যে বিশ্বজুড়ে মন্তব্যের বন্যা বয়ে গেছে। অনলাইন ‘আরবান ডিকশনারি’তে উদাহরণসহ ‘শিটহোলে’র অর্থ দেওয়া হয়েছে এ রকম : ‘ট্রাম্পের মুখ, যে জায়গা থেকে যখন তখন বিপুল পরিমাণ বর্জ্যপদার্থ নির্গত হয়।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দরিদ্র দেশের বাদামি বর্ণের অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও নরওয়ের শ্বেতাঙ্গ মানুষদের চান। অথচ নরওয়েবাসীর কেউ আমেরিকার মতো একটি শিটহোল দেশের অভিবাসী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে না। নরওয়ের অনেকেই টুইটারে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেছেন : ‘নরওয়েবাসী শিটহোল আমেরিকায় যাবে কেন?’

ব্রেট স্টিফেনস ‘গর্তের দেশে বাস করে গর্বিত’ (দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, জানুয়ারি ১২, ২০১৮) শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে গর্তের ভেতর থেকে উঠে আসেননি। কিন্তু তিনি গর্তেই ঢুকছেন। এটা হয়তো তার রাজনীতিতে ক্ষতি করবে নাÑযদিও রিপাবলিক্যান দলের লজ্জাহীন নেতারা খবর গরম থাকাকালীন বিড়বিড় করে প্রতিবাদ করবেনÑতবে দেশের ক্ষতি করবে। আমাদের প্রেসিডেন্ট বহির্বিশ্ব সম্পর্কে যত অজ্ঞ, যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তারচেয়ে বেশি। প্রেসিডেন্টের মাথায় সত্যি কোনো গোলমাল আছে হয়তো। যেকোনো নোংরা কিছু দিয়ে ওটি পাল্টানো যায়।’

যুক্তরাষ্ট্রকে আবার উচ্চে তোলার জন্য ট্রাম্পের উদ্ভট পদক্ষেপসমূহের মধ্যে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা। মেক্সিকোর সীমান্ত বরাবর একটি দুর্ভেদ্য, লম্বা, শক্তিশালী, সুন্দর দেয়াল নির্মাণ যাতে করে দেশটি থেকে মাদক, অপরাধ ও ধর্ষকরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে! লাখ লাখ যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘ওবামাকেয়ার’ শীর্ষক স্বাস্থ্যবিমা সংস্কার নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন। তারই চিন্তাপ্রসূত কর্ম, দেশটিতে শিশু বয়সে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে যারা এখন তরুণ, তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে কদিনের জন্য মার্কিন সরকার অচল হয়ে পড়ে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার এবং এসব যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিকভাবে দুর্বল করার জন্য স্রেফ চীনাদের ধোঁকাবাজিÑএসব প্রচারই তার দেশটিকে মহান করে তোলার নির্বোধ প্রচেষ্টা। পরিবেশ দূষণকারী শক্তির পরিবর্তে বিশ্ব যখন সৌর, বায়ু ও অন্যান্য বিকল্প শক্তির দিকে আগাচ্ছে, তখন সেই বৈশ্বিক উদ্যোগে নেতৃত্ব দেওয়া দূরে থাক, যুক্তরাষ্ট্র বেশি করে কয়লার গর্তের মধ্যে নামছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিই হোক আর ইরান পারমাণবিক চুক্তি হোক, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওবামার সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করতে ট্রাম্প আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে মহান করে তোলার জন্য ট্রাম্পের আরেকটি পদক্ষেপ হচ্ছে, করপোরেটদের ওপর থেকে কর হ্রাস। আর এটাকে মানুষের কাছে তাদের ‘কষ্টার্জিত অর্থ’ ধরে রাখার একটা উপায় হিসেবে প্রচার করে দেশটির মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে ঠকানো। কারণ তার এই করহ্রাস ধনিক শ্রেণিকেই লাভবান করবে। জোসেফ স্টিগলিজ ‘ধনীদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের করহ্রাস যুক্তরাষ্ট্রকে বড় করবে না’ শীর্ষক নিবন্ধে (দ্য গার্ডিয়ান, ২৭ জুলাই ২০১৭) লিখেছেন, ‘বর্তমানের লোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে হারবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। লোভীদের সেরা আবার তারা, যাদের কপাল খুলেছে জুয়াখেলার মতো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মের মধ্য দিয়ে।’

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিগলিজ আরেকটি নিবন্ধে লেখেন, রিপাবলিক্যানদের কর-পরিকল্পনা ‘মধ্যবিত্ত মানুষের কোনো কাজে আসবে না। তাদের বরং আরো বেশি কর দিতে হবে। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিয়োনেয়ার ও বিলিয়োনেয়ারদের জন্য আশীর্বাদ।’ আর ‘ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেছিলেন ওয়াশিংটনের বদ্ধ ডোবা সাফ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। পরিবর্তে ডোবাটি এখন আরো প্রশস্ত ও গভীর হয়েছে। রিপাবলিক্যানদের প্রস্তাবিত করÑসংস্কার যুক্তরাষ্ট্রের পুরো অর্থনীতিকে এই ডোবায় চোবানোর ইঙ্গিত বহন করছে।’

‘শিটহোল’ দেশ হওয়া মোটেও ভালো নয়, খারাপ। তাই বলে এটি কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ হলো সারা বিশ্বকে শিটহোল বানানোর চেষ্টা, সারা বিশ্বকে নোংরা করার যুক্তরাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ ও দখল, অন্য দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের হত্যা করা ও তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে মদদ দেওয়া, উন্নয়নশীল দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা, পারমাণবিক আক্রমণ করে শহর ধ্বংস ও নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা এবং সব সময় বিভিন্ন দেশ ও তার সরকারকে এসব হুমকি দিয়ে বেড়ানোÑ এগুলো বিরাট অপরাধ। এসব অপরাধ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ডালভাত, তার প্রতিদিনের রুটিন। বর্তমান আর কোনো দেশের বিরুদ্ধে এত অপরাধের অভিযোগ নেই।

গোপন অভিযানে ও সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে দেশে দেশে সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার যে তালিকা গ্রাহাম ফুলার দিয়েছেন তা চমকে ওঠার মতো : কোরিয়া (১৯৫০-১৯৫৩), ইরান (১৯৫৩), গুয়াতেমালা (১৯৫৪), কোস্টারিকা (১৯৫৪), সিরিয়া (১৯৫৭), ইন্দোনেশিয়া (১৯৫৮), ডোমিনিকান রিপাবলিক (১৯৬০), পেরু (১৯৬০), ইকুয়েডর (১৯৬০), কঙ্গো (১৯৬০), ভিয়েতনাম (১৯৬১-১৯৭৩), কিউবা (১৯৬১), ব্রাজিল (১৯৬৪), চিলি (১৯৭২), অ্যাঙ্গোলা (১৯৭৫), নিকারাগুয়া (১৯৮১), লেবানন (১৯৮২-১৯৮৪), গ্রেনাডা (১৯৮৩), পানামা (১৯৮৯), ইরাক/উপসাগর (১৯৯১), সোমালিয়া (১৯৯৩), বসনিয়া (১৯৯৪-১৯৯৫), কসোভো (১৯৯৯), আফগাস্তিান (২০০১-বর্তমান) এবং ইরাক (২০০৩-বর্তমান)।

যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরা দেশে দেশে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এই তালিকা তার একটি নমুনা মাত্র। প্রকৃত তালিকাটি অনেক দীর্ঘ। এত সব বড় বড় অপরাধ করার ক্ষমতা ট্রাম্প-অভিহিত কোনো শিটহোল দেশের নেই। এ হচ্ছে বিশ্বকে শিটহোল বানানোর পশ্চিমা প্রকল্প, যুক্তরাষ্ট্র যার নেতৃত্বে। পৃথিবীর সর্বাধিক অস্ত্রসজ্জিত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, জলবায়ুর উষ্ণতা ইত্যাদিসহ হাজারো সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা তার নেই, পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করার ক্ষমতা তার আছে। আর এই সর্বাধিক শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিংসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। এ রকম ব্যক্তির যে সহনশীলতা, শালীনতা ও সহমর্মিতার বোধ থাকা প্রয়োজন ট্রাম্পের তা নেই।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে (৩ জুলাই ২০১৭) ‘যুক্তরাষ্ট্রের ছিনতাই হওয়া প্রেসিডেন্সি’ শীর্ষক লেখায় চার্লস এম ব্লো লিখেছিলেন, ‘একটা পাগল ও তার আইনপ্রণয়নকারী পা-চাটার দল যুক্তরাষ্ট্রকে জিম্মি করে ফেলেছে।’ তার মতে, ‘ট্রাম্প একটা ঘৃণা ও জাতীয় ক্যানসার এবং তার হাতে ক্ষমতার লাগাম থাকা পর্যন্ত আমাদের কারো শান্তি নেই।’ এটি অবশ্য ব্লো সাহেবের নিজের সমস্যা, জগতের সবার না। কারণ ডেনাল্ড ট্রাম্প একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে নিচে নামানো। এ জন্য সোভিয়েত নেতা গরবাচেভের মতো ট্রাম্পও একটি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন! পাওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের জয় হোকÑএই আমাদের প্রার্থনা।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist