মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
ইসলাম
ব্যবসা-বাণিজ্যে নীতিমালা
ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের যে আবর্তন সৃষ্টি হয় তা কেবল ব্যক্তিকে উপকৃত করে না, সমাজের সাধারণ মানুষের বহুবিধ কল্যাণ তা দ্বারা সূচিত হয়। পণ্যদ্রব্যের গতিশীলতা ও স্থানান্তর নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য তা সবার কাছে সহজলভ্য করে। কর্মসংস্থান বহুবিধ সুযোগ অবারিত করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে। এসব কারণে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে তাতে নিয়োজিত হতে ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে। কোরআনে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল এবং হারাম হিসেবে পার্থক্য করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদার! তোমরা একে অপরের সম্পদ বাতিল পন্থায় গ্রাস করো না। তবে তা ব্যবসায়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মতিতে হলে বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। এখানে বাতিল পন্থা বলতে ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান পরিপন্থী ব্যবসাকে বোঝায়। হারাম বস্তু ব্যবসা, জোর-জবরস্তিমূলক লেনদেন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদির মাধ্যমে অপরের সম্পদ আত্মসাৎ, আমানতের খেয়ানত, মুদি কারবার, জুয়া-লটারি ইত্যাদি মাধ্যমে আয়। এসব বাতিল পন্থায় লেনদেন ইসলাম হারাম করেছে। এসবই অবৈধ ব্যবসার দৃষ্টান্ত। পক্ষান্তরে ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান অনুসারে যেসব লেনদেন পরিচালিত হয় তাই বৈধ বা হালাল ব্যবসা। অবৈধ ব্যবসাকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে এবং প্রতিহত করতে বিধিবদ্ধ আইন তৈরি করেছে। অন্যদিকে বৈধ ব্যবসাকে ইসলাম অনুমোদন দিয়েছে এবং জীবিকা অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হিসেবে তাতে নিয়োজিত হতে ব্যক্তিকে উৎসাহিত করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ বাণিজ্য
পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে লেনদেন : ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। লেনদেন উভয় পক্ষ যদি লাভবান বা উপকৃত হয় তাহলেই কেবল পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে উঠবে এবং বৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যথায় তা হবে না। বিক্রেতা যদি অযৌক্তিক অতিরিক্ত মূল্য থেকে অত্যধিক লাভ করতে চায় এবং ক্রেতা বাধ্য হয় সে মূল্যে ক্রয় করতে, তাহলে এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে লেনদেন হবে না। ইসলাম এ ধরনের লেনদেন অনুমোদন করে না। লাভ একটু কম হলেও ক্রেতার সন্তোষ অনুসারে মূল্য নির্ধারিত হলে পারস্পরিক সহযোগিতা সৃষ্টি হবে।
লেনদেনে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি : ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে লেনদেনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি থাকতে হবে। বিক্রেতা দ্রব্যের যে মূল্য নির্ধারণ করে তা যদি ক্রেতা কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত না হয়, বরং ওই মূল্যে ক্রেতা ক্রয় করতে বাধ্য হয়, তবে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বলা যাবে না। একইভাবে শ্রমিক অভাব-অনটনের কারণে বা অত্যাচারের ভয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, তাহলে তা স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি হবে না। এখানে একপক্ষের সম্মতি পাওয়া যায়নি। বিপাকে পড়ে জবরদস্তি সম্মতিকেই স্বতঃস্ফূর্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাসুল (সা.) ‘বিপাকে পড়ে বাধ্য হয়ে লেনদেন’ করতে নিষেধ করেছেন।
প্রতারণামূলক লেনদেন অবৈধ : লেনদেনে ধোঁকা বা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কেননা এর ফলে বিক্রেতা লাভবান হলেও ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নকল দ্রব্য অথবা ভেজাল মিশিয়ে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করা, নিকৃষ্ট বস্তুতে উৎকৃষ্ট বলে চালিয়ে দেওয়া, মাপ বা ওজনে কম দেওয়া এসবই প্রতারণার শামিল। এ ধরনের লেনদেন ইসলামে হারাম। জুয়া বা লটারির মাধ্যমে বিক্রয় প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। কেননা তাতে একপক্ষের নিশ্চিত লাভ এবং অন্যপক্ষের নিশ্চিত ক্ষতি নিহিত রয়েছে। উপরন্তু জুয়া বিনা পরিশ্রমের ফসল। পূর্ণ বিনিময় প্রদান না করে অথবা স্বল্প বিনিময়ের পরিবর্তে অধিক অর্জন। কাজেই তা এক ধরনের আত্মসাৎ, জুলুম ও মারাত্মক প্রতারণা। এ জন্যই জুয়া এবং লটারির মতো সব ধরনের লেনদেন ইসলাম হারাম করেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একদিন রাসুল (সা.) বাজারে এক স্তূপ খাদ্যশস্যের ভেতর স্বীয় হাত মোবারক ঢুকিয়ে দিলেন। এতে তার আঙুল ভিজে গেল। তিনি বললেন, ‘হে শস্যের মালিক! এটা কী?’ সে বলল, ‘এগুলো তো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি স্তূপের উপরিভাগে এগুলো রাখলে না কেন, যাতে লোকে দেখতে পারে। যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ১৩১৫)।
মাপ বা ওজনে কম দেওয়া অবৈধ : ইসলামের দৃষ্টিতে লেনদেনে মাপ বা ওজনে কম দেওয়া কঠিনতম গুনাহ। কেননা এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। হাতের কারসাজি, দাঁড়িপাল্লায় কারচুপি, কম ওজনের বাটখারা দিয়ে ওজন করা ইত্যাদি উপায়ে লেনদেন করে ক্রেতাকে ঠকালে তার জন্য কঠিন শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে কোরআনে। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা মাপে কম করে তাদের জন্য দুর্ভোগ। যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা পুনরুত্থিত হবে সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। (সুরা মুতাফফিন : ২-৬)। ওই আয়াতে বিক্রেতাকে কিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিবস সম্পর্কে সতর্ক করে তাকে বলা হচ্ছে, সেদিন বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে তার কাজের জবাবদিহি করতে হবে। এ কথা স্মরণ রেখে তাকে যথাযথভাবে লেনদেন করা উচিত।
মিথ্যা শপথ করে বিক্রয় হারাম : লেনদেনে মিথ্যা শপথ করা থেকে বিরত থাকতে বিক্রিতাকে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। দ্রব্যে যেই গুণ নেই তা আছে বলে বা নিকৃষ্ট বস্তুকে উৎকৃষ্ট বলে শপথ করে বিক্রি করা ইসলাম হারাম করেছে। কেননা এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। পণ্যদ্রব্যে কোনো ত্রুটি থাকলে তা ক্রেতাকে দেখিয়ে তার সম্মতিতে কমমূল্যে বিক্রি করা যাবে। অন্যথায় তা হারাম হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বাজারে পণ্য আমদানি করে মহান আল্লাহ্ তাআলার নামে কসম খেল যে, এর এত দাম লাগানো হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কেউ বলেনি। এতে তার উদ্দেশ্য সে যেন কোনো মুসলমানকে পণ্যের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে পারে। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাজিল হয়, ‘যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর তাদের সঙ্গে কিয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিও দেবেন না। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (বোখারি : ১৯৫৮)।
হারাম বস্তুর ব্যবসা হারাম : শরিয়তের দৃষ্টিতে যেসব বস্তু হারাম, তার ব্যবসাও হারাম। মদ, শুকর, প্রতিমা, মৃতজীব, সুদি কারবার ইত্যাদি বস্তুর ব্যবসা হারাম। একইভাবে হালাল বস্তুর সঙ্গে যদি হারাম মেশানো হয়, তবে সে ব্যবসাও হারাম হবে। যেমন : ভালো চাল, ডাল বা গমের সঙ্গে পচা ও ক্ষতিকর চাল, ডাল ও গম মিশিয়ে বিক্রি করলে তা হারাম হবে। হালাল ফলের সঙ্গে মদ মিশিয়ে বিক্রি করলে তাও হারাম হয়ে যাবে। যে হালাল বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় দ্বারা হারাম কাজে সহায়তা করা হয় তাও ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। আঙ্গুর ও তার রসের ব্যবসা হালাল। কিন্তু আঙ্গুর বা রস যদি মদ তৈরির জন্য বিক্রয় করা হয় তাহলে ওই ব্যবসা ও তা থেকে আয় হারাম হয়ে যাবে। এখানে কোরআনে সেই বাণী প্রণিধানযোগ্য যাতে বলা হয়েছে, ‘সৎকর্ম ও আল্লাহ-ভীতির একে অন্যের সহযোগিতা করো। পাপ ও অন্যায় কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা মায়িদা : ২-৩)।
অস্বাভাবিক মুনাফা হারাম : ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবসা করে। ইসলাম মুনাফা অর্জন হালাল করেছে, তবে মাত্রাধিক বা অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন হারাম করেছে। কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া, যখন তখন ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন ইসলাম অনুমোদন করে না। এমনিভাবে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় করার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করা ইসলাম হারাম করেছে। মজুদের ফলে পণ্যদ্রব্য অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। বাজারে সরবরাহের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্য দেখা দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। এরই পরিণতিতে ক্রেতা সাধারণকে প্রয়োজনবোধে বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করতে হয়, নতুবা তার ভোগ-ব্যবহার ত্যাগ করতে হয়। বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় করে বিক্রেতা অত্যধিক লাভবান হলেও ক্রেতা তথা ভোক্তারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে জনস্বার্থ বিঘিœত হয়, সমাজ জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। এ জন্যই ইসলাম মজুদ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। হজরত মা‘মার থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে লোক খাদ্যসামগ্রী গুদামজাত করে, সে অপরাধী; সে গুনাহগার সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম : ১৬০৫)।
লেখক : কলামিস্ট ও ইসলামী গবেষক
"