এস আর শানু খান

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

চিড়িয়াখানা

পশুপাখিরা ভালো নেই

বিনোদন প্রতিটি মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিনোদন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এমন একটা অধ্যায় যেটা ছাড়া জীবন অচল প্রায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, বিনোদন ও দরিদ্রতা একদম বিপরীতমুখী। দরিদ্রতা যেখানে বিনোদন সেখানে গুমড়ে মরে। দরিদ্রতার কাছে প্রতিনিয়ত কত যে শখ, আহ্লাদ আর আশা-আকাক্সক্ষা পরাজিত হয়ে ঝরা ফুলের মতো বিলীন হয়ে যায়। মনের গহিনে নীরবে নির্বিঘেœ কেঁদে কেঁদে ক্ষ্যান্ত হয় কত যে অতৃপ্ত আশা-আকাক্সক্ষা। তবু মানুষ জীবনেক টিকিয়ে রাখতে সুযোগ পেলেই ছুটে যায় একটা বিভিন্ন রকম আনন্দ-বিনোদনের সন্ধানে। একবার ঢাকা গিয়েছিলাম চাকরির সন্ধানে। সঙ্গে গিয়েছিল আমার বন্ধু অপূর্বও। দুজনে গিয়ে উঠলাম অভিজিতের বাসায়। অভিজিতের বাসা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে। চাকরির অফিসে গিয়ে অভিনব কায়দায় ঘুষ চাওয়ায় নিরাশ হয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার মন খারাপ ও মানসিক চিন্তাগ্রস্ততা দেখে অপূর্ব জোর জুলুম করে নিয়ে গেল চিড়িয়াখানা দেখতে। ঢাকায় গিয়েছি অনেকবার। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কখনো কোনোদিন যাওয়া হয়নি কোথাও। বিশেষ করে রাজধানীর কোনো বিনোদন কেন্দ্রে। কেন জানি ভালো লাগে না আমার। অবশ্য এর পেছনে কারণও রয়েছে। হাতেগোনা টাকা নিয়ে বিনোদন চলে না। বাড়ি পৌঁছানোর চিন্তা মাথায় থাকে। যাইহোক, নাছোড় বান্দা অপূর্বর জন্য সেদিন গিয়ে হাজির হলাম মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। পরের দিন খুব সকালে রওনা হলাম জানযটের ভয়ে। কিন্তু তবু ক্ষমা পেলাম না। বিরাট সব জ্যাম পাড়ি দিয়ে ১১টায় গিয়ে পৌঁছালাম। আমি, অভিজিত আর অপূর্ব। আর মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে ছোট ভাই আশিক এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটল অপূর্ব। সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে ডুকে পড়লাম আমরা চারজন। হাতে সময়ও কম। বিকেল ৩টায় অভিজিতের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। অভিজিত আগেও একবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল ওর দিদিদের সঙ্গে। তাই তো ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। বাম পাশের একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। প্রথমেই চোখে পড়ল শকুনের খাঁচা। দুটা শকুন। তারপর দুটা খাঁচা ফাঁকা। এরপর দেখলাম একটা গ-ার। বেশ কিছু হরিণ। এরপর আরো কিছু খাঁচা ফাঁকা দেখলাম। হাঁটতে লাগলাম সবাই। চিড়িয়াখানার ভেতর প্রচুর মানুষের সমাগম। বেশির ভাগই গ্রাম থেকে আসা মানুষ। পরিবার নিয়ে। শিশু-কিশোরের সংখ্যাই বেশি। আর এক শ্রেণির আজব জীবও এসেছে চিড়িয়াখানায় সেটা হলো প্রেমিক-প্রেমিকা। চিড়িয়াখানার যে জায়গাগুলো একটা নিরিবিলি সেখানের সব বেঞ্চ দখল করেছে ওই অসাম্প্রদায়িক শালীনতা ভোলা যুগলরা। এরপর দেখলাম গাধা, ঘোড়া, জিব্রা, জিরাফ, বন গরু, দেখলাম জলহস্তীসহ আরো নাম না জানা অনেক জন্তু। এসব জন্তুও খাঁচায় সামান্য কিছু চাষের ঘাস ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। এরপর বেশ কয়েক ধরনের সাপে ও খরগোশ দেখলাম। দেখলাম সাদা ও কালো ময়ূর। বিভিন্ন রঙের টিয়া, ঘুঘু, বক, কাক, শালিক, ময়না, সারস, উটপাখি, কবুতরসহ অনেক পাখি। যেগুলোর কোনো খাঁচায় খাদ্যের কোনো চিহ্নই চোখে পড়ল না। এই পাখিগুলোর চোখেমুখে নিরাশার ছাপ। বিরহের ছোঁয়া। নীরবতাই বলে দিচ্ছে তাদের অসহায়ত্বের নানা অভিযোগ। দেখলাম বানরের মতো জীবও নিরীহ খরগোশের মতো বসে অনাথের মতো তাকিয়ে রয়েছে মানুষের দিকে। যার নামই হলো বানর। সেই বানরও আজ ভদ্র সেজে বসে রয়েছে চিড়িয়াখানায়। কারণ একটাই পেটে তাদের খিদের যন্ত্রণা। ছোটবেলায় একবার প্রাইমারি স্কুল থেকে লোহাগড়া শিশুপার্কে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম বানর ঠিক বানরের মতোই সব আচার-আচরণ করছিল। এক সেকেন্ডও স্থির হচ্ছিল না। রওশন স্যার আমাদের ডেকে বলছিল এই দেখ বানর। শুধুই এর নাম বানর হয়নি। দেখছো এ এক সেকেন্ড ও এক জায়গায় দুই পা রাখতে না। সেই বানর দেখি আজ ভদ্র হয়ে বসে রয়েছে। বানরের পাশেই সিংহ মামার খাঁচা। বনের রাজা সিংহ মামার করুণ অবস্থা। পেটের দুই পাশের চামড়া গিয়ে ঠেকে চামড়ায়। ঠনঠনে একটা দেহ। বোঝায় যাচ্ছে না এটা সিংহ নাকি বাজারের ফেও কুকুর। না খেতে খেতে বাজারের ছোলা কুকুরের মতো অবস্থা সিংহ মামার। খাঁচার বাইরে থেকে কত মানুষ কত কী করছে। ছোট ছোট কিছু ছুড়ছে কিন্তু উঠেও দাঁড়াচ্ছে না বেচারি। অসহায়ত্ব ভরা চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আবার ঘুমোনোর ভান ধরছে। খেয়াল করলাম। সিংহের খাঁচায় খাদ্য বলে কিছুই নেই। আশিক বলল, কত দিন যে দেয় না সেটাই বা জানে কেনা। স্পষ্ট মনে আছে, লোহাগড়ার শিশুপার্কের সিংহ মামার খাঁচার পাশে দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না। শুধু মাংস পচার গন্ধে। আর জাতীয় চিড়িয়াখানায় সিংহের খাঁচায় মাংস তো দূরের কথা ঘাসের নমুনাও পেলাম না। বাঘ, বানর, হায়েনা, শিম্পাঞ্জি,//// গরিলা, গিরগিটি দেখলাম। পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে একটা একটা জিনিসের শব্দ শুনতে পেলাম সেটা হলো শিম্পাঞ্জির হু হু আওয়াজ। মাত্র দুটা শিম্পাঞ্জি খাঁচার ভেতর খেলা করছে আর হু হু আওয়াজ করছে। অনেক খাঁচা খালি দেখলাম। তা আনুমানিক চিড়িয়াখানায় যতগুলো খাঁচা রয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশ খাঁচাই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। তাও আবার বেশির ভাগ ফাঁকা খাঁচাতে বানার রেখে বিভিন্ন দেশের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় বেশি। এমন দেখলাম যে, সাইবোর্ডে এ নাম রয়েছে অন্য পশুর অথচ ভেতরে রয়েছে বানর। বানরের অভাব নাই তো, তাই তো বানর দিয়েই পূর্ণ রেখেছে খাঁচা। বানরের খাঁচা বাদ দিলে চিড়িয়াখানার প্রায় অর্ধেক খাঁচা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। চিড়িয়াখানার পশুপাখি, জীব-জন্তুর যে করুণ পরিস্থিতি, নিজ চোখে দেখে এলাম কেন জানি মনে হলো শিগগিরই পুরো চিড়িয়াখানা পশু-পাখি ও জীব-জন্তুবিহীন চিড়িয়াখানায় রূপান্তরিত হবে। তখন মানুষ চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখতে গিয়ে শূন্য খাঁচা দেখে ফিরে আসবে। যে দেশে হাজার কোটি টাকায় ব্যয়ে পদ্মা সেতু হয়, যে দেশে কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার হয় সেই দেশের চিড়িয়াখানায় না খেতে পেরে মরে যাওয়া পশুপাখি আর জীব-জন্তুর গল্প লেখতেও লজ্জা হয়। চাকরি না হওয়ার কষ্ট ভুলতে বিনোদন করতে চিড়িয়াখানায় গিয়ে কষ্ট ভোলার পরিবর্তে পশুপাখি আর জীব-জন্তুদের না খাওয়া আর অসহায়ত্বের নালিশ শুনে কষ্টের বোঝা আরো ভারী করে বের হলাম চিড়িয়াখানা থেকে। ঘড়িতে তখন ১টা ৪৫ মিনিট। বের হয়ে তিন টাকার শিঙাড়া ১২ টাকা দিয়ে খেলাম। ১৫ টাকার পানি ২৫ টাকা দিয়ে কিনতে হলো। গাড়িতে উঠে ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা করে দিতে হলো। বুঝতে বাকি রইল না চিড়িয়াখানা এলাকায় দুর্নীতির জুড়ি নেই। যে যার মতো পারছে লুটে পুটে খাচ্ছে। আগেপিছে ভাববার সময় নাই তাদের। চিড়িয়াখানা থেকে ফেরা মানুষগুলো গাড়ির ভেতর বলাবলি করছিল। চিড়িয়াখানায় নাকি দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এমন চলতে থাকলে খুব অল্পদিনেই নাকি মানুষ আর আসবে না। কথাগুলো আমার কানে এলো। কোনো হিসাব মেলাতে পারলাম না নিজে। কেন এমন করে ওরা। কেন এই অবিচার চিড়িয়াখানার নিরীহ, নির্বাক জীব-জন্তুর ওপর। এ দেশে কেউই কি নেই যে, জাতীয় ঐতিহ্য বলে নয় শুধু পশু-পাখিদের কষ্ট বুঝে এগিয়ে আসবে। তাদের সঠিক প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist