আলতাফ হোসেন খান

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

সামাজিক অবক্ষয় এবং আমরা

অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ও অপরাপর নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান সময়ে আমাদের আপন সমাজের কেমনতর অবয়ব তা সচেতন সামাজিক মাত্রেরই জানা। তথাপি নানাবিধ অপরিহার্য ব্যস্ততা হেতু আপন স্বার্থেই আপন চেহারা অবলোকন করে নেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।

রমনা পার্ক, নর্থ সাউথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং ইউনিভার্সিটি, কারমাইকেল কলেজ ও রেইন। পাঠক শব্দগুলো সবারই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু যদি বলি এগুলোর প্রায়োগিক ভিন্নতাও রয়েছে অর্থাৎ আপনি এ শব্দগুলো বলতে যা বোঝেন তার বাইরেও ভিন্ন অর্থে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তখন নিশ্চয়ই একটু খটকা লাগবে। হ্যাঁ, এ শব্দগুলো বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে পর্নো ভিডিও ফুটেজের কোড নেম হিসেবে। যার একেকটি ফুটেজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকায়। মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ ইত্যাদি মাধ্যমে এগুলো হস্তান্তর হয়। যার প্রধান ক্রেতা স্কুল-কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীরা। আজ-কাল প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে নিয়মিতই এর ভয়াবহতা তুলে ধরা হচ্ছে। লেখা হচ্ছে বিস্তর। প্রশাসন মাঝেমধ্যেই অভিযান পরিচালনা করছে। জব্দ করছে এ ধরনের ভিডিওসংবলিত বিপুল পরিমাণ মেমোরি কার্ড পেনড্রাইভ। জেল-জরিমানাও কম করা হচ্ছে না। তথাপিও এর ব্যাপকতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ফুটেজগুলোয় অংশ নেওয়া ছেলেমেয়েরাও যেমন এ সমাজের অংশ। তেমনি যারা এর ক্রেতা তারাও এ সমাজেরই অংশ; এর সিংহভাগই আবার তরুণ প্রজন্ম। যারা স্বাধীনতার নামে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বেলেল্লাপনার শেষসীমা অতিক্রম করে চলেছে নিত্য। আমরা জেনেও এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে বরং তাদের সহযোগিতাই করে চলেছি । আমাদের নাটক-সিনেমা গানে তুমি-আমি ছাড়া কিছু নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটাকে উসকে দিচ্ছে আরো। ভাবখানা এমন যেন বন্ধু পাশে থাকলেই হলো আর কারো প্রয়োজন নেই, বন্ধুত্ব মানেই প্রেম। প্রেমের জন্যই জীবন। ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক, ফেসবুক মানেই ফেক আইডি আর মিথ্যের ছড়াছড়ি। বন্ধুত্ব-প্রলোভন, প্রেম অতঃপর বাস্তবতার ঘাড়ে রক্তাক্ত অন্তর। এরপরে নেশা। বলে রাখা ভালো, ফেসবুকেও আছে জ্ঞানগর্ভ অনেক ভালো পাতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এর পাঠক সংখ্যা নেহাতই নগণ্য।

অনলাইনের বিশাল তথ্যভা-ারের ধারেকাছেও ঘেঁষে না বেশির ভাগ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। এমনকি ব্লগ সম্পর্কেও বেশির ভাগেরই ধারণা নেই। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার। এরা সারাদিন অনলাইনে কী করে? তারা যদি ব্লগ নিয়ে মেতে থাকত। মেধার অপচয় নয় চর্চায় মনোনিবেশ করত। তাহলে আজকের এই লেখার অবতারণাই হতো না। আজকের শিক্ষিত তরুণ যদি অনলাইনের বিশাল তথ্যভা-ারের সঙ্গে পরিচিতই না হতে পারে। যদি সেখান থেকে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে না পারে। সর্বোপরি বিশ্ব পরিম-লে নিজেদের সংযুক্তই করতে না পারে তাহলে তাদের অর্জিত শিক্ষাই যে এ দেশের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘হত্যাকা-’ বাংলাদেশে এখন নিয়মিত ঘটনার একটি। রাজধানীতে এর মাত্রা বোধ হয় একটু বেশি। সমাজে মূল্যবোধের এত অবক্ষয় ঘটেছে যে তাকে আর কোনো যন্ত্রে মাপা সম্ভব হচ্ছে না। চামেলীবাগের জোড়া খুনের ঘটনা আগেকার একাধিক জোড়া খুনের ঘটনার মতো সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। লেখাজোখাও কম হয়নি। সমাজে প্রতিক্রিয়াও তেমনি। এ বিষয়ে একজনের মন্তব্য : মাদকসেবী ছেলের হাতে মা বা স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন কাগজে দেখা যায়, কিন্তু মেয়ের হাতে বা তার সংশ্লিষ্টতায় মা-বাবা খুন, তাও পরিকল্পিতভাবে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, এমন ঘটনা বোধ হয় এই প্রথম। ‘ঘটনা প্রথম’ কি দ্বিতীয় তা জানাটা জরুরি নয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, সমাজে অবক্ষয় ও অনৈতিকতা বড় গভীরে পৌঁছে চারদিকে শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। উৎস মাদক বিপণন ও মাদক গ্রহণ। আর এই ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধির প্রতিরোধে দরকার জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা ও তার কার্যকর প্রয়োগ। দরকার এ বিষয়ে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ। পরিবার তথাকথিত আধুনিকতার নামে সন্তানদের সুস্থ মানসিক বিকাশ ও বড় হয়ে ওঠার দিকে নজর দিচ্ছেন না। যে জন্য ছেলে হোক, মেয়ে হোক শিক্ষার্থী পর্বে প্রায়ই সঙ্গীদের প্রভাবে বিপথে যায়। সুস্থ পারিবারিক প্রভাবই (মূলত মা-বাবার) এ অবস্থার যথাযথ প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি এ বিষয়ে যথাযথ মাত্রায় মানোন্নত নয়। স্নেহ ও শাসনের ভারসাম্য শিশুর সুস্থ মানসিকতায় বেড়ে ওঠার পূর্বশর্তÑএ কথা আমরা জানি, কিন্তু মানি না। অতিবিত্তবান ধনী পরিবারের বখাটে ছেলেমেয়ের কথা বাদ দিলেও মধ্যবিত্ত পরিবারেও এমনটা দেখা যায় এবং তা শৈশব-কৈশোর থেকে দেখভালের অভাবে। মা-বাবা যদি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, পরিবারের উঠতি সদস্যদের দেখভাল করা ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা যদি না থাকে, এর পরিণাম পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যদের জন্য সর্বনাশা হয়ে উঠতে পারে। পরিবারে অপরিণত বয়সী সদস্যদের মধ্যে মাদকাসক্তির যে ব্যাপক বিস্তার, তার মূল কারণ পারিবারিক অবহেলা বা উদাসীনতা। অবশ্য ব্যতিক্রমী কারণ থাকতেই পারে। ‘ঐশী’ সুন্দর একটি নাম। এ নামের কিশোরী সম্পর্কে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য জানা গেছে, তাতে উল্লিখিত বক্তব্যই মূল কারণ। তবে অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা নির্দেশ করে না বরং ধর্মই পারে ধর্মান্ধতার অভিশাপ থেকে সবাইকে মুক্ত করতে। ধর্মই মানুষের জীবন প্রণালি অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছে কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতার খোঁজ মেলে না যেটি ধর্মহীনতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে বরং অনেক সভ্যতাই ধ্বংস হয়েছে অধর্ম, সামাজিক অনাচার আর অবিচারের ফলে।

এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করাসহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয় প্রতিরোধ করা আজ আমাদের সবার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। যার শুরুটা হতে হবে পরিবার থেকেই। এটা সবারই মনে রাখা উচিত, সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু মূল দায়িত্বটি পরিবার তথা সমাজকেই নিতে হয়। সন্তানকে সময় দিন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার বন্ধুদের জানুন। তাকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিন। একই সঙ্গে মনে রাখা খুবই জরুরি, সর্বাগে যা প্রয়োজন তা হলো বিষয়টি প্রতিরোধে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অবক্ষয় মেরামতে এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist