শফিকুল ইসলাম খোকন

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

ডিএনআই ২০১৮ : মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

দেশের যেকোনো আইন সর্বজনীন, কোনো ব্যক্তি বা মহলের জন্য আইন তৈরি হয় না। সব আইনই হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। কেউ দুর্নীতি, অন্যায় করলে ওই আইনের আওতায় আসবে। সে মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, এনজিওকর্মী, সাংবাদিক কিংবা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটালে শাস্তির আওতায় আসে বা আসতে বাধ্য। আমরা প্রতিটি নাগরিকই অন্যায়-অপরাধ করতে চাই না। ওসব কাজে জড়াতেও চাই না। দেশের সব আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ সব সময়ই থাকে বা করতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা নিয়ে সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা বয়ে যাচ্ছে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ বহুল আলোচিত কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্তির বিধান পুনর্বিন্যাস করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ৩২ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সর্বমহলে।

আমার এক সহকর্মী সাংবাদিক ৫৭ বা ৩২ ধারাসহ সাংবাদিকতা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা জানি একটি পুকুরে মানুষ পড়লেই যখন মারা যাবে অথবা পড়ে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে, তাহলে মারা যাওয়া থেকে বিরত থাকতে ওই পুকুরের চার পাশে ঘোরাঘুরি করার কী দরকার? ওই ধারাগুলোয় যে ব্যাখ্যা রয়েছে ওইসব কাজ না করলেই তো হয়?’ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকদের কাজ কী? সংবাদ সংগ্রহ করা, সংবাদ পরিবেশন করা, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা। আইনের ব্যাখ্যায় যা রয়েছে সেটিতে পুরোপুরি ফলো করে বা করতে হয় সাংবাদিকদের। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ভুয়া আইডিও ব্যবহার করে সম্মানহানিরও স্ট্যাটাসও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে এ আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তার দিকে তাকিয়ে মূল লক্ষভ্রষ্ট সমীচীন নয়। অথচ এসব আইডিতে মানহানিকর স্ট্যাটাসের কারণে চিহ্নিতও হয়নি বা বন্ধ না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে মুক্ত সাংবাদিকদের সাংবাদিকতাকে বিব্রত করা নয় কি? প্রশ্ন হচ্ছে, আইন যদি সর্বজনীনই হয় এবং ৫৭ বা ৩২ ধারা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এটি লেখলে বা প্রকাশ করলে অপরাধ হয়, তাহলে কেন বিগত বছরগুলোয় শুধু ৫৭ ধারার আওতায় সাংবাদিকরা আসবে, কেনই বা ৫৭ ধারায় শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হবে? এই অপরাধে কজন ব্লগার, সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? ওই ধারায় তো সাংবাদিক শব্দটি উল্লেখ নেই? তাহলে কেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এত মামলা? কথায় বলে অপরাধ নির্মূলের চেয়ে অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমরা সব সময়ই অপরাধ ঘটার পরেই সবকিছু নিয়ে ভাবি, ঘটার আগে নয়। সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া ৭৪০টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা রয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হওয়ার পর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারা দেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২-তে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একটি কথার সঙ্গে আমিও একমত। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিয়ে বলেছেন, ‘এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণœ হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’ (সূত্র : বাংলাট্রিবিউন, তারিখ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭)। শুধু জনপ্রতিনিধি কেন একজন সুইপারেরও মানসম্মান রয়েছে। তার এ কথা থেকেই মনে হয়েছে কি-না এমপিদের মানসম্মান রয়েছে, আর কারো নেই।

ধারা নিয়ে আমার কোনো মতবিরোধ নেই। আমি বরাবরই ৫৭ ধারা কেন সব আইনের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল এবং পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু ধারার ব্যাখ্যার বিষয়টিতে আমার আপত্তি। এর আগে ৫৭ ধারায় যত মামলা হয়েছে তার বেশির ভাগই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এ কারণেই এত সমালোচনা। বিগত দিনের সমালোচনার আলোকে আমার মনে হয়েছে ৫৭ ধারাটি মনে হয় শুধুই সাংবাদিকদের জন্য। ওই ধারায় কী বলা আছেÑ৫৭(১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি ৫ অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যুন সাত বৎসর কারাদ-ে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ-ে দ-িত হইবেন।

প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে গোপনে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ফেসবুকে এ নিয়ে দেওয়া স্ট্যাটাসে অনেকেই লিখেছেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। নতুন মোড়কে পুরোনো পণ্য, অথবা বোতলটা নতুন, তবে মদটা পুরোনো নয়।

সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের আপত্তির মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন বাতিল নিঃসন্দেহে সরকারের শুভবুদ্ধিরই পরিচায়ক। তবে মন্ত্রিসভায় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন করা হয়েছে তাতে ঘুরেফিরে ৫৭ ধারা বহাল রাখা হয়েছে কিনা সেটি বড় মাপের একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে স্বাধীন সাংবাদিকতাও এগিয়ে যাবেÑএমনটাই প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে এমন কোনো আইনপ্রণয়ন করা মোটেও কাম্য হবে না, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে কিংবা মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। আমরা মনে করি, সংসদে পাস হওয়ার আগে আইনটি আবার বিবেচনা করা হবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist