নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের কৃষি, বন, মৎস্য, জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এটা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সব ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ আজ খুবই জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের ক্ষয়ক্ষতির দিকগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরা এবং এর মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ উপলব্ধি থেকেই সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এরই মধ্যে ‘জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ প্রণয়ন এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ ও ‘জলবায়ু পরিবর্তন রেজিলিয়েন্স ফান্ড’ নামে দুটি তহবিল গঠন করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশগুলো তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা পাঁচ ভাগ হারাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই দেশগুলোর নীতিমালা প্রণয়নে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে ১৭টি অভীষ্ট রয়েছে, তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও অসমতা দূরীকরণÑএই অভীষ্ট দুটিকে মোকাবিলা করতে হবে একই সঙ্গে। জাতিসংঘের বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তথ্যে দেখা যায়, গড়ে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হয়েছে ৬৪ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে। বাড়ছে বন্যার প্রবণতা ও লবণাক্ততা। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বিনষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছে। গত চার দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ফসলি জমিতে লবণের মাত্রা বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে গত এক দশকে লবণের মাত্রা বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে প্রায় তিন কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তাও জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি ও মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞরা। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৩০ শতাংশই দক্ষিণাঞ্চলে। লবণের কারণে শুকনো মৌসুমে এই এলাকার অধিকাংশ জমিই অনাবাদি থাকে। সিডর আইলার মতো প্রলঙ্করি ঝড়ের কারণে বাড়িঘর, গাছপালা, গবাদি পশুসহ সহায় সম্পদ হারিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বাপ-দাদার চির পরিচিত বাড়ি-ভিটা হারিয়ে রাজধানীর বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। এতে করে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সিডরে প্রাণ হারায় ৩ হাজার ৪০৬ জন। আহত হয় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। ঘরবাড়ি ভেঙে, মাছ ও ফসল নষ্ট হয়ে, গাছ পড়ে আহত হওয়াসহ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮৯ লাখ মানুষ। সিডরে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন মায়ের মতো বুকে শিশু আগলে ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি ২৬ লাখ টাকার সম্পদ বাঁচিয়েছে। ছয় লাখ তিন হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতো। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৬ হাজার ৪৫৭টি জলবায়ু সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এসব দুর্যোগে প্রাণ গেছে প্রায় ছয় লাখ মানুষের। এর বাইরে ৪২০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদিত এসডিজিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও অসমতা দূরীকরণÑএ দুটি অভীষ্টকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জরিপে বলা হয়েছেÑএ দুটি অভীষ্ট একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এ দুটি অভীষ্টকে মোকাবিলা করতে হবে একই সঙ্গে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টির অবস্থানই এশিয়ায়। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে বাংলাদেশ। এর পরেই রয়েছে ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান ও মিয়ানমার। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৪০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন লোক বসবাস করে এবং যার বেশির ভাগই দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ইন্টার গবার্নমেন্টাল প্যানেল ফল ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় এলাকার ৮০ লাখ এবং সারা দেশে প্রায় দুই কোটি লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তচ্যুত হতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে ২০১০ ও ২০১১ সালে এশিয়ার সাড়ে চার কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে প্রায় এক লাখ লোক। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উপকূলীয় ও নদীভাঙনের কারণে প্রতি বছর ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ লোক, লবণাক্ততার কারণে ১ লাখ ২০ হাজার, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে তিন থেকে চার লাখ লোক, জলাবদ্ধতার কারণে সাড়ে তিন লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি বছর উপকূলীয় ও নদীভাঙনের কারণে ৬০ হাজার, লবণাক্ততার কারণে ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। আর জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রতি তিন বছরে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই বছর বিশ্বে ৩৬ হাজার ২৬১ টন কার্বন নিঃসরণ হয়। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে চীন ১০ হাজার ৩৫৭ টন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যথাক্রমে ৫ হাজার ৪১৪ টন ও ২ হাজার ২৭৪ টন। ওই সময় বাংলাদেশের নিঃসরণ করা কার্বনের পরিমাণ ছিল ৭৭ টন। বিশ্বের ৫১টি দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব আবহাওয়া অধিদফতর (ডব্লিউএমও) বলছে, ২০১৬ সালে বিশ্বের বায়ুম-লে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড জমা হয়েছে তা বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ২০১৫ সালে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয়েছে, তা এর আগের ১০ বছরের গড়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস গড় হার ছিল ৪০৩ দশমিক ৩ পিপিএিম, এর আগের বছর এই হার ছিল ৪০০ পিপিএম। বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের এ ব্যাপারে অভিমত হলোÑকার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়ার জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনা পূরণ করা সম্ভব হবে না এবং সেই সঙ্গে ব্যর্থ হবে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা।

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধরন দেখা যাচ্ছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও দৃশ্যমান হচ্ছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে দুটি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর। ওই ক্ষয়ক্ষতি এখন পর্যন্ত আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সামনে দুর্যোগ বাড়লে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য আমাদের এখন থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের ধারণা-কার্বন নিঃসরণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে। ফলে বাংলাদেশের মতো দেশে বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের তীব্রতা বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আমাদের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist