ফয়জুন্নেসা মণি

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ভাষা

তোমাদের ঋণ শোধ হবে না

মা-মাতৃভূমি-মাতৃভাষা-এই তিনটি বিষয় এক সুতোয় গাঁথা। জার্মানের এক গবেষক তার গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেনÑশিশুরা মাতৃভাষা বোঝে গর্ভ থেকেই। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নারীর বন্ধন। তাই প্রকৃতিগতভাবে জন্মসূত্রে আমরা মায়ের ভাষা আত্মস্থ করতে পারি। যে ভাষাটি মায়ের গর্ভ থেকে শেখা সে ভাষা কি কেউ কেড়ে নিতে পারে! মোটেও না। আমরা যে ভাষায় কথা বলছি, মায়ের ভাষা হলেও তা অর্জন করতে অনেক রক্তমূল্য দিতে হয়েছে। সে কারণে মায়ের কাছে আমাদের যেমন ঋণ, তেমনি মায়ের ভাষার কাছেও অশেষ ঋণী আমরা। এ ঋণ রক্তের ঋণ। ১৯৫২ সালে এ মাটির সন্তানরা প্রমাণ করেছিল মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় সন্তানরা জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। মায়ের ঋণ যেমন কখনো শেষ করা যায় না, তেমনি মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায় কোনো দিন মোচন হবে না। বাংলা ভাষা আমাদের আত্মপরিচিতি এবং আত্মবিকাশের বাহন। আর একুশ হচ্ছে সেই চেতনার সূত্র। একুশ না হলে ভাষার মর্যাদা অস্তমিত হতো। একুশের চেতনাই বিশ্ববাসীদের জানিয়ে দিয়েছিল পাললিক মাটির উর্বরতা। আর সে কারণেই একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ বাঙালি সত্তার ঠিকানা। বাঙালিদের মাতৃভাষার গৌরবে গৌরবান্বিত হতে শিখিয়েছে একুশ। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছে একুশ। একুশ মানে হাত ধরাধরি করে চলা। একুশ মানে বিবাদ নয়; বন্ধুতা। একুশ মানে আত্মত্যাগ আর স্বাধিকার আন্দোলনে গর্জে ওঠা। একুশ আমাদের তাই শিখিয়েছে। তাই প্রতি বছর আমরা পরম শ্রদ্ধা, মমতা ও ভালোবাসায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করি। গর্বের কথা হলোÑএখন সারা বিশ্বে পালিত হয় এ দিবসটি। বিশ্ব ভাষাবাসীরা জানছে মায়ের মুখের ভাষার জন্য বীর বাঙালির গৌরবগাথা। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। জীবনের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা অধিষ্ঠিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-শফিউরসহ নাম না জানা অনেক শহীদ ভাই এবং সে সময়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে আমাদের। কেননা, আমরা গর্বের সঙ্গে যা উপভোগ করছিÑতা কেবল সেইসব মানুষের আন্দোলনেরই ফসল।

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’Ñএই গানটির বাস্তবতাও ছিল সে রকম। পাকিস্তানের গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্রসমাজ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করে। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক ভাষণে ‘উর্দু’কে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। এই আন্দোলন থেমে থেমে চলমান থাকে। এরপর ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘর্মঘট পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস, ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। এ সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিসংবলিত ব্যাজ বিক্রয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের অর্থ সংগ্রহ শুরু হয়।

রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনে বাংলা মায়ের সন্তানদের ব্যাপক প্রস্তুতির মুখে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার সব সমাবেশ ও শোভাযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। সেদিনের শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় নিরস্ত্র বাঙালি সন্তানদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তানি পুলিশ। নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর রহমানসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ ভাইদের স্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় প্রথম শহীদ মিনার। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির তোপের মুখে পরাজিত হয় শক্তিধর পাকিস্তানি হায়নাদের ভাষা দমননীতি। রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে বাংলা মায়ের সন্তানরা। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম আর জীবন দানের ইতিহাস শুধু বাঙালিদেরই আছে। এ জন্য আমরা গর্বিত জাতি; বাংলা আমাদের গর্বের ভাষা। এই বিরল ত্যাগী ইতিহাসের কারণেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পায়। ভাষা আন্দোলনের এই চেতনা থেকেই ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় স্বাধিনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্ত হয় ভাষার নামে একটি দেশের নামÑবাংলাদেশ।

ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষি সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাভাষীদের স্থান চতুর্থ। তার পরও আমরা জাতীয়তায় বাঙালি হলেও ভাষার বাঙালি এখনো হতে পারিনি। বাংলা ভাষার চিন্তাচর্চা এবং ব্যবহার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বাংলা-ইংরেজির মিশেল ভাষায় কে কী বলছি, কেন বলছিÑতা-ই বোঝা দায়। অনেকে ইংরেজি বলতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গর্ব করে ইংরেজি বলেন। অনেক জায়গায় ইংরেজি না বললে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ তারা কতটা সঠিক ও বিশুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন এ বিষয়ে অনেক সন্দেহ থেকে যায়। রাস্তায় নামলে ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ডে ছয়লাপ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই চিত্র। অথচ আমাদের নদীগুলোর কী অপূর্ব শ্রুতিমধুর নাম। নাম নিলেই যেন হৃদয় ভরে যায়। মধুমতী, চিত্রা, ব্রহ্মপুত্র, তিতাস, করতোয়া, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, আড়িয়ালখাঁ, কর্ণফুলী, সুরমা, রূপসা, ভৈরত, তুরাগ-সব নামই যেন পরিপূর্ণ বাউলিয়াপনায় ভরপুর। তাই শুধু নামে নয় জীবনের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ অতি জরুরি। ইংরেজি জানতে হবে, আরো অনেক ভাষা জানা ভালো। কিন্তু সবার আগে হবে মায়ের ভাষা।

নিজেদের কথায়, লেখায়, অনুভবে সমুজ্জ্বল করে তুলতে হবে বাংলা ভাষাকে। মাম্মি, ড্যাডির পরিবর্তে চিরমধুর ডাক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দÑ‘মা’ ডাকলে কত মধুর লাগে। বাবা ডাকলে কত মধুর লাগে। স্কুলে, কলেজে, অফিসে, আদালতের সাইনবোর্ডে ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি থাকা আবশ্যক হওয়া উচিত। নিজেদের টিভি চ্যানেলে, পত্রিকায় ভাষার প্রতি এই আবেগটির প্রয়োগ ঘটালে ভাষার ব্যবহার সমুজ্জ্বল থাকবে। পাশাপাশি শিক্ষক, পেশাজীবীসহ অভিভাকরা এ বিষয়ে সচেতন হলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে আমরা দায় মোচন করতে পারব। সারা পৃথিবীতে এখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা ভাষাভাষীরা। সবার চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে জড়িয়ে রাখতে পারলে পৃথিবীর বুকে উচ্চতম আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে আমাদের মায়ের ভাষা। তাই সবার প্রতি আহ্বানÑসবাই যেন মাতৃভাষার চর্চা করি। মায়ের ভাষায় কথা বলি অবিরাম।

লেখক : কবি ও শিক্ষিকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist