মোহাম্মদ আবু নোমান
মতামত
খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংক
ব্যাংকের সঙ্গে যাদের লেনদেনের সম্পর্ক তারা বেশিরভাগই শিক্ষিত, সচেতন; সবারই চোখ-কান খোলা। সবাই জানেন এবং বোঝেন প্রশিক্ষিত ও সৎ কর্মকর্তার সমন্বয়ের সঙ্গে- জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, যোগ্য লোক ব্যতীত কোনো ব্যাংক কিছুতেই সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। অতীত কি বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট। দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যার শেষ নেই। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট না থাকার কারণেই মূলত ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগিসহ আমানত খেয়ে ফেলায় সেখানেও খেলাপির সংখ্যা আরো ভয়াবহ। মোট কথা খেলাপিদের কাছে জিম্মির সঙ্গে খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংকিং খাত।
নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবারের চারজন সদস্য বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। এতে তিন বছর করে তিন মেয়াদে মোট ৯ বছর একাধারে পরিচালক থাকতে পারার সুবাদে ব্যাংকগুলোতে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে মূলত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে। কিছু ব্যাংকে আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কখনো খেলাপি ঋণ থামানো যাবে না। একটি বেসরকারি ব্যাংকে মাত্র ১০ শতাংশ মালিকানা থাকে পরিচালকদের, বাকি ৯০ শতাংশ টাকা জমা রাখেন সাধারণ আমানতকারীরা। মাত্র ১০ শতাংশ মালিকানার সুযোগে তারা অনিয়ম, জালিয়াতির এমন কোনো দিক বা ফাঁকফোকর নেইÑযা করে না। গত ১০ বছরে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ ফেরত পাওয়া যায়নি। খেলাপি ঋণের এসব টাকা আর আদায় হবে কি? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক।
২০১৭ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডি মনে করছে, ‘এ পরিস্থিতি ২০১৮ সালেও তেমন পরিবর্তন হবে না, দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আগের চেয়ে এখন আরো বেশি নাজুক...।’ পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের এক বছর পার না হতেই খেলাপি ঋণের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের নাম। ব্যাংকটির এমন অবনতিতে অবাক গ্রাহক এবং শুভাকাক্সক্ষীরা।
ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির ক্যাপ্টেন বা মূল চালিকাশক্তি বলা হয়। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে ঋণ দেওয়া এবং সময়মত সে ঋণ আদায় করা। ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হলো এ ঋণ। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ, কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগসহ শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম রেখে সুষম উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। দুর্বল সুশাসন, উচ্চ করহার, আর্থিক অপরাধ ও চুরি অব্যাহত থাকা এবং ন্যায়নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ব্যবসার পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি শেয়ারবাজারে ধস, বেকারত্বের মহামিছিল। এজন্য দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতকে ইতিবাচক ধারায় রাখা ও কোম্পানি, বীমাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সৎ ও সহজ-সরল বোঝাপড়া দরকার।
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে যেকোনো উপায়ে অধিকাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের নৈতিকভাবে আরো বলীয়ান, পর্ষদে দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকার, পরিচালকদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি উভয় খাতে ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক ও তদারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সমস্যার মূলে গিয়ে আরো কঠোর হতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"