এস এম মুকুল

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

স্মরণ

প্রেরণার বাতিঘর

পায়ে স্যান্ডেল হাতে ছাতা অথবা সদাইয়ের জন্য চটের ব্যাগ। কখনো হেমন্তের ফসল কাটা জমির ওপর আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটছেন। কখনো বর্ষাকালের প্রবল বর্ষণে খানাখন্দ আর ভাঙাচোরা সড়কের খন্তা পেরিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন তিনি। অথবা ফিরতি পথে চটের ব্যাগভর্তি সদাই নিয়ে বাড়ির পথে চলেছেন। যাওয়া আসার পথে হয় কোনো ছাত্র অথবা অভিভাবক এসে বলছেনÑ ‘স্যার, ব্যাগটা আমার হাতে দিন, আমিও এ পথেই যাব।’ ভাটিপাড়া থেকে মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় আড়াই কিলোমিটার পথজুড়ে স্যারের সঙ্গে কেউ না কেউ আছেন।

গল্পের জাদুকর এই মহান শিক্ষক হাস্যরসের স্ফুরণ ছড়িয়ে মাতিয়ে রাখছেন পথযাত্রীদের। কী এমন কথা তিনি বলতেন? কোন জাদুর টানে কাছে টেনে নিতেন সবাইকে। কালপরিক্রমায় সে বিষয় হয়তোবা মূল্যায়িত হবে অথবা হবে না। কিন্তু তবু থেকে যাবে মহান এই শিক্ষকের পরম মমতায় তিলতিল করে গড়ে তোলা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর চেতনায় ভাস্মর হয়ে থাকা একজন শিক্ষকের হিরন্ময় মুখ। তিনি আর কেউ নন, সিংধার শাহ্ আজিজ স্যার। মরহুম আব্দুল আজিজ শাহ্। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের প্রিয় সিংধার শাহ্ আজিজ স্যার। মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অনুকরণীয় শিক্ষক। আজ ২ ফেব্রুয়ারি মহান এই শিক্ষকের মৃত্যুদিবস। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯০ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সেকালের শিক্ষকতা পেশা ছিল নির্লোভ আদর্শের স্তম্ভ। শিক্ষকরা ছিলেন সমাজেরও শিক্ষাগুরু। তেজস্বী শিক্ষক যেমন ছিলেন, ছিলেন কড়া মেজাজের শিক্ষক অথবা মোলায়েম। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। সে সময় শিক্ষার হার ছিল কম। মানুষ ছিল অভাবগ্রস্ত। তখন যারা ম্যাট্রিক পরীক্ষা অনুত্তীর্ণ হতেন তাদের বলা হতো নন-ম্যাট্রিক! নন-ম্যাট্রিকেরও গুরুত্ব ছিল। স্যার বলতেন, ‘গরিব কৃষকের সন্তানরা লেখাপড়া শিখুক। টাইন্যা-টুইন্যা ম্যাট্রিক পাস করুক অথবা হোক নন-ম্যাট্রিক, কিছু একটা কইরা খাইতে পারব। অশিক্ষিত বাবা-মা ঠকবে না।’ হাটে-বাজারে, পথচলায় যাদের সঙ্গে দেখা হতোÑ তিনি বলতেন, ‘পুলা-মাইয়ারে ইস্কুলে পাঠান, পড়ালেখা শিখুক। চাকরি না হইলে, ব্যবসাপাতি কইরা সংসারের হাল ধরতে পারব।’ স্যারের এমন প্রেরণামূলক কথায় অনেক অভিভাবক আগ্রহী হলেও তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে বলতেনÑ ‘স্যার, পড়ালেহা করাইবার তো মন চায় তবে খরচাপাতি দিতা ফারতাম নাতো, আমরা গরিব মানুষ। বই খাতা কলম ম্যালা খরচ। তাছাড়া জমিজমা করব ক্যালা?’ স্যার নিজেও ছিলেন কৃষিজীবী পরিবারের একজন। তিনি সবকিছুই উপলব্ধি করতেন। তাই অভিভাবকদের এমন বাস্তব সত্যকে সহাস্য অগ্রাহ্য করে বলতেনÑ ‘আরে মিয়া, আমি আছি না। বেতন অর্ধেক মাফ লইয়া দিমু। গরিবের সন্তান পড়ালেখায় ভালো হইলে বেতন পুরাটাই মাফ অইব। হেড মাস্টার আর ক্লাস টিচারের সঙ্গে কথা যা কওনের আমিই কব। খাতা কলমটা আপনেরা কিইন্যা দিয়েন। আর আমি উপরের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের পুরান বই দিতে কইয়া দিবনে। সমস্যা অইব না।’ এই সেই শিক্ষক যিনি তার একজীবনের শিক্ষকতা পেশায় রেখে গেছেন এমন অজ¯্র মানবীয় দীক্ষার নজির। এ কারণেই হয়তোবা গ্রামের নামানুসারে তিনি তার প্রিয় ছাত্র ও অভিভাবকদের কাছে সিংধার আজিজ স্যার নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী, রঙ্গরসময় এবং সরল-কোমল মনের অধিকারী মানুষ। প্রাণপ্রিয় সন্তানের মতো, বন্ধুর মতো প্রাণখোলা সরলতায় মিশতেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। নেত্রকোনা জেলায় স্কাউটিং বিকাশের অগ্রদূত ছিলেন তিনি। ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেকেলে অভিভাবকদের তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কাউটিংয়ে নিয়ে আসতেন। পরম যতœ নিয়ে, উদ্দীপনা দিয়ে ছাত্রদের স্কাউটার হিসেবে গড়ে তুলতেন। স্যারের স্কাউটিং দীক্ষায় অনেক অনেক স্কাউটারের জীবনবোধ বদলে গেছে। শরীরচর্চা এবং ক্রীড়াঙ্গনে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার প্রতীক। শাহ্ আজিজ স্যার নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে সংস্কৃতি, ক্রীড়াঙ্গন এবং স্কাউটিংয়ে অনন্যমাত্রায় পরিচিতি দিয়েছিলেন। একাজে নিজের সবটুকু শ্রম, মেধা, সেবা আর দক্ষতাকে বিলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শাহ্ আজিজ স্যারের নেতৃত্বে নেত্রকোনা জেলায় স্কাউটিং বিকশিত হলেও বাংলাদেশ রোভার স্কাউটস তাকে যথাযথ মর্যাদা বা স্বীকৃতি দেয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ স্কাউটিং বিকাশে নিবেদিতপ্রাণ এমন শিক্ষকের তথ্য পর্যন্ত স্কাউটের কেন্দ্রীয় দফতরে নেই। তারই নিপুণ দক্ষতায় গড়ে তোলা স্কাউটার বাংলাদেশ স্কাউটিংয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল পদক অর্জন করে মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে গৌরবোজ্জ্বল পরিচিতি এনে দেয়।

মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি বিদ্যালয়টি দুর্গত হাওরাঞ্চলের শিক্ষা অর্জনের অন্যতম পাদপীঠ হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য এই শিক্ষক অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তাদের লজিং থাকার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে শুরু করে বেতন মওকুফসহ সবরকম সহায়তা করতেন বলেই ভাটিবাংলার ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে তিনি ছিলেন পরম আস্থা ও ভরসাস্থল। আরেকটি ঘটনাÑ বুধবার মোহনগঞ্জের হাটবার। মোহনগঞ্জ বাজারে সুনীল ডাক্তারের হোমিও চেম্বারে বসে আছেন স্যার। মধ্য বয়সী একজন গৃহস্থ লোক এসে সালাম দিয়ে বললেনÑ ‘স্যার, আফনের ধারো আইছি।’ স¦ভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্যার বললেনÑ ‘কি মিয়া, কি জন্যে আমারে খুঁজতাছেন।’ জনৈক বললেনÑ ‘স্যার, আমার বাড়ি ভরতপুর। আমার পুলাডা এইবার এইট কেলাসে উঠল। তিন বিষয়ে ফেইল করছে। ছেলে কইছে আপনের কারণে বিশেষ বিবেচনায় এইবার ফাস (পাস) করতে পারছে।’ স্যার বললেনÑ হুম, ছেলে তো পড়াশোনায় ভালো না। এখন কী সমস্যা?’ নিরীহ ভদ্রলোক ভয়কাতুর কণ্ঠে বললেনÑ ‘স্যার, আফনে তো জানেন, আমি কৃষক, অভাব অনটনের সংসার। আফনের দয়া ছাড়া পুলাডারে আর সামনে আগাইয়া নিবার ফারতাম না।’ হাসিমুখে স্যার বললেনÑ ‘আরে মিয়া বাড়িত যান, চিন্তা কইরেন না। ছেলের বেতন মওকুফের জন্য আমি ক্লাস টিচার আর দরকার হইলে হেড মাস্টারের সাথে কথা কইয়া কমাইয়া দিমুনে।’

এ অঞ্চলের গরিব পরিবারের শিক্ষার্থীদের প্রাণপণ চেষ্টায় সহায়তা করেছেন। একজন শিক্ষকের প্রধানতম দায়িত্ব শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা, শেখানো আর প্রেরণায় উজ্জীবিত করা। কিন্তু তিনি ছিলেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরম নির্ভরতার আশ্রয়কেন্দ্র। একটি ঘটনা। এক ছাত্রের প্রমোশন আদায়ের জন্য তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে স্যারকে রাজি করাতে পারেননি। মর্মাহত হয়ে স্যার ক্লাস টিচারকে বললেনÑ ‘দেখেন মাস্টার সাব, এরা গরিবের পুলাপান। কৃষিকাজ কইরা খায়। পড়াশোনা বেশি ভালো না মানলাম। এদেরকে যদি প্রমোশন না দেন তাইলে কালকে থাইক্যা বাপে এদেরকে লাঙ্গলের খুঁটি ধরাইয়া দিব। বুঝবার চেষ্টা করেন, এদের বাপের পড়াইবার ক্ষেমতা নাই।’ এই ব্যাপারটায় ক্লাস টিচারের মন মজলো। তিনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেনÑ ‘স্যার, যান আপনার কথাই রাখলাম।’ এই হলেন শাহ আজিজ স্যার। যিনি শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য অসংকোচে যা করার তাই করতেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে তো বটেই, অসংখ্য অভিভাবকের কাছে তিনি ছিলেন পরমপাত্র। নিরহঙ্কারী এই শিক্ষক পরবর্তীকালে তারই ছাত্রের সঙ্গে সহকর্মী হিসেবে অনবদ্য সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে স্বপেশায় কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

স্কুলের যেকোনো সমস্যা, উৎসব, আয়োজনে স্যারের ওপর গুরুদায়িত্ব পড়ত প্রধান শিক্ষকের পক্ষ থেকে। স্যার এসেম্বলি ক্লাস নিতেন। হেড স্যার একদিন এসেম্বলি ক্লাসে খুব ক্ষেপে গেলেন। বেশ কয়েক ছাত্র স্কুলড্রেস পরে আসেনি। দুয়েকজন লুঙ্গি পরে এসেছে দেখে স্যার রেগেমেগে ক্লাস টিচারের মাধ্যমে তাদের নাম কেটে দিলেন। হেড স্যারকে খুশি করার জন্য তিনি সেখানেই এই ক’জন ছাত্রকে বেত দিয়ে মারলেন। আর আস্তে করে ওদেরকে বললেনÑ ‘তোদের নাম আমি তুইলা দিবনে।’ তারপর হেড স্যারকে শুনিয়ে জোরে বললেনÑ ‘কাল থেকে ড্রেস পরে আসবি, তা না হলে খাতায় নাম উঠবে না।’ পরে হেড স্যারের কক্ষে গিয়ে তিনি স্বভাবসুলভ হাস্যরসিকতায় বোঝালেনÑ ‘স্যার, এরা গরিবের সন্তান। এখন বর্ষাকাল। অনেকে দূরদূরান্ত থাইক্যা রাস্তায় অনেক পানি ভাইঙ্গা স্কুলে আসে। এই জন্য সবসময় ড্রেস পইরা আসা সম্ভব না। লুঙ্গি পইরাই আসতে হবে। আমি নিজেও তো বাজারে আইসা প্যান্ট পরি। ওদের নাম খাতায় তুইল্যা দিইÑ কী করবেন স্যার।’ হেড স্যার মৃদু হেসে সম্মতি দিয়ে বললেন- ‘শাহ্ সাব, আপনি আপনার ছাত্রদের এত ভালোবাসেন, ঠিক আছে।’ আসলে তখনকার বাস্তবতা ছিল এ রকমই। রাস্তায় অনেক জায়গায় পানি পার হয়ে আসার জন্য লুঙ্গি পরেই আসতে হতো।

স্যার অবসরে যান ১৯৮৯ সালে। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি পরলোকে পাড়ি জমান। সরলতা, মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয়রাজ্যে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। তার মতো এমন শিক্ষক এ যুগে সত্যিই বিরল। কালের মহিমায় অজ¯্র শিক্ষার্থীর হৃদয়ে এমন নিবেদিত শিক্ষক বেঁচে থাকুন-এটাই একমাত্র চাওয়া।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist