আলতাফ হোসেন

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী

জলবায়ুর প্রভাবে ও শিকারিদের দৌরাত্ম্যে ভালো নেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশের প্রাণিসম্পদ। ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় তিন শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে আরো শ-খানেক। প্রকৃতির প্রতি মানুষের নৃশংসতা, পরিবেশদূষণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টির মন্তব্য প্রাণীবিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, সময়ের সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা আরো জোরালো হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরো ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হতে পারে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ (ডব্লিউটিবি) ও দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশ শাখার এক জরিপে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের প্রায় দেড় শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, মেরুদ-ী প্রাণীর ১৩টি, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় তিন শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। একইভাবে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ১০৬ প্রজাতির নলবাহী উদ্ভিদ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, বন্যপ্রাণী শিকার, নদীর নাব্য হ্রাস, ভারসাম্যহীন পরিবেশ, অবহেলা ও অযতেœর কারণেই বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রজাতির এসব প্রাণী। হারিয়ে যাচ্ছে নানা জাতের গাছ ও মাছ। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়বে দেশ। এতে দেখা দিতে পারে বিশাল প্রাকৃতিক শূন্যতা। আইইউসিএনের বন্যপ্রাণীবিদ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে তারা পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন।

বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে : নানাবিধ কারণ বিশেষত খাবারের চাহিদাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে যথেচ্ছ শিকারের ফলে অনেক প্রাণীই আজ বিলুপ্তির পথে। এর পূর্ণ বিবরণ দেওয়াও কঠিন হয়ে উঠেছে আজকাল। তবে এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রাণীর বিবরণ দেওয়া গেল, যারা কিছুদিন আগেও ব্যাপক সংখ্যায় ছিল কিন্তু এখন খুব কমই অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে প্রথমেই যার কথা আসে সেটা হলো গ্রিজলি ভাল্লুক, মেক্সিকোর সিয়েরা মাদ্রে থেকে শুরু করে কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে কিছুদিন আগেও এদের বিপুল সংখ্যায় মিলত। কিন্তু বর্তমানে মাত্র কয়েক শ অবশিষ্ট আছে। নুবিয়া মরুভূমির বুনোগাধা, উত্তর-পূর্ব সুদানে বিপুল সংখ্যায় দেখা মিলত এদের। প্রায় বিলুপ্তির ফলে। দুর্ভিক্ষপীড়িত ওই অঞ্চলে মূলত খাবারের প্রয়োজনে এদের মেরে শেষ করে ফেলা হয়েছে। ব্র্যান্ডেরস সেয়োম্প হরিণ, বর্তমানে শুধু ভারতের মধ্য প্রদেশের কানহা অভয়ারণ্যে কোনোমতে, টিকে আছে তারা। সংখ্যায় ২-১শ’র বেশি হবে না। সোমালি বুনো গাধা, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়াতে এদের প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এদের নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কুসংষ্কার ছিল যে, এদের চর্বি হচ্ছে যক্ষ্মার ওষুধ। আর যায় কোথায়? কাজেই চলেছিল ব্যাপক হত্যা। এ ছাড়া পানির অভাবেও মারা গেছে অনেক। বর্তমানে অল্প কয়েক শ অবশিষ্ট আছে। ম্যাকলিনস হরিণ, তিব্বতের মালভূমিতে এরা চরে বেড়াতো হাজারে হাজারে। এদের নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সংস্কার ছিল। আর তা হলো, এদের নতুন শিং চূর্ণ করে খেলে যৌবন ফিরে পাওয়া যায়। কাজেই হতভাগ্যরা আজ বিলুপ্তির পথে। ড্যাম্পিং হরিণ, ভারতের মণিপুরে পাওয়া যেত। মূলত গোশতের প্রয়োজনে এদের ব্যাপকহারে শিকার করা হয়েছে। প্রায় বিলুপ্তির পথে। পশ্চিমা ট্রাগোপান বা মতিলাল পাখি, আগে এদের ভারতে দেখতে পাওয়া যেত। আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। কিট শিয়াল, কানাডার দক্ষিণ-পশ্চিম সাসকাচিউয়ান প্রদেশের সাইপ্রাস পাহাড়ে এককালে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে দেখাই যায় না এদের। মূলত চামড়ার লোভে মেরে শেষ করে ফেলা হয়েছে। লিমিয়েন শিয়াল, ইথিওপিয়ার সিমিয়েন পার্বত্য অঞ্চলে পাওয়া যেত। এখন আর দেখা যায় না। স্যান জোয়াকিন শিয়াল, উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় দু-একটা মেলে আজও। এরাও মূলত দামি চামড়ার কারণেই নিঃশেষ হয়েছে। সোনালি সিংহমুখো মারমসেট বানর। ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলে পাওয়া যায়। কলা আর আখখেতে হামলা চালাত বলে মেরে মেরে শেষ করে আনা হয়েছে। আর বড়জোর শ-পাঁচেক জীবিত আছে ওরা। রোমশ মাকড়সা বানর, এদেরও দক্ষিণ ব্রাজিলে দেখা যেত। এরাও ফসলের ক্ষতি করত বলে মেরে মেরে এদেরও শেষ করে আনা হয়েছে। অতিকায় ভোঁদড়, দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, ব্রাজিল, কলাম্বিয়ায় দেখা মেলে আজও। তবে শেষ হয়ে এসেছে। মরেছে দামি চামড়ার অধিকারী বলে। বল্গা হরিণ, রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং স্কানডিনেভিয়াতে এরা একসময় হাজারে হাজারে চরে বেড়াত। মূলত গোশতের চাহিদা পূরণের জন্যই মারা হয়েছে। সামান্য সংখ্যকেই অবশিষ্ট আছে। জাভা ও সুমাত্রার গ-ার, চামড়া ও ওষুধের (ভুল বিশ্বাস) প্রয়োজনে খড়গ, পায়ের নখ, রক্ত ইত্যাদির জন্য এদের মারা হয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েক শ মাত্র অবশিষ্ট আছে। আফ্রিকান গ-ার, সুদান, উগান্ডা ও কঙ্গোতে পাওয়া যায়। বর্তমানে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। জাপানের টাকসিমা দ্বীপের সি-লায়ন, এরা মূলত একজাতের সিল। কোরিয়ার যুদ্ধের সময়ে এবং পরে উদ্বাস্তুদের গোশতের প্রয়োজনে শেষ হয়েছে। দু-একটাকে দেখা যায় আজও। ক্যারিবিয়ান মংকসিল, চর্বির জন্য এদের মারা হয়েছে। বর্তমানে অল্প কয়েকটাই বেঁচে আছে। নীলতিমি, বর্তমানে কয়েক হাজার বেঁচে আছে। তবে পেশাদার শিকারিদের হাতে পড়ে এরাও বিপন্নদের তালিকায়। এভাবে যদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে শিকারিদের হামলায় ও মানুষের বাসস্থানের কারণে বন উজাড় হয়, তাহলে পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়ে নানা বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাস্তবায়ন দরকার সঠিক আইন প্রয়োগের আর জনসচেতনার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist