আলতাফ হোসেন

  ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বইমেলা ও গ্রন্থনীতি

বই আমাদের জ্ঞান অর্জনে সহায়ক। মানবিক জীবন তখন পরিপূর্ণতা পায়, যখন সে জ্ঞানের সংস্পর্শে আসে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা কতটুকু বই পড়ছি কিংবা গ্রন্থনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমাদের দেশে বই কেন্দ্র করে প্রকাশক-লেখক-পাঠকের সর্ববৃহৎ সম্মিলনী হচ্ছে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। এ মেলার জন্য সারা বছর লেখক-প্রকাশক-পাঠক অপেক্ষায় থাকেন। মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন নতুন বই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রার চালচিত্রই শুধু পরিস্ফুট করে না, এর মধ্য দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। একুশে গ্রন্থমেলা এখন আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির বহুমাত্রিক বিকাশের ফলে মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা অনেকেই শঙ্কিত; তবে প্রযুক্তির সঙ্গে মুদ্রিত বইয়ের চিরায়ত ঐতিহ্য যুক্ত করে নতুন দিনের বিপ্লব সম্ভব। নব্বই দশকের শুরুতে মুক্ত গণতন্ত্রের সূচনার কারণে কিনা, মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রকাশনী সংস্থার অংশগ্রহণও। স্বাভাবিকভাবে বিক্রি-বাট্টাও। আর দেড় দশক ধরে ফেব্রুয়ারির বইমেলা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম বর্ণাঢ্য বাণিজ্যিক আয়োজন।

আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যাবতীয় আয়োজন ও বিনিয়োগের সিংহভাগ এই ফেব্রুয়ারির বইমেলা উপলক্ষ করে। তবে এ কথা মানতেই হবে, যদি শুধু একটি মাস বা মৌসুম বিবেচনায় রেখে তৎপরতা চালানো হয় তবে তা কোনো শিল্পের জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়। কিন্তু চাই বা না চাই, এ দেশের প্রকাশনা শিল্পের ভবিতব্য যেন তাই হয়ে গেছে। সারা বছর ধুঁকতে থাকা এই শিল্প যেন ফেব্রুয়ারির দু-তিন মাস আগে থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। বছরে যত বই প্রকাশিত হয়, তার ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ প্রকাশিত হয় এ সময়। ফলে দেখা যায়, বেশির ভাগ বই স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে দায়সারা সম্পাদনায়, যেনতেন বাঁধাই আর অশোভন পরিপাট্য নিয়ে ক্রেতা তথা পাঠকের বরাবরে উপস্থিত করা হয়। দেশের বয়স চল্লিশ ছাড়ালেও আমাদের প্রকাশনা শিল্প তার চেয়েও অনেক বর্ষীয়ান। কিন্তু এখনো সাবালকত্ব অর্জনের চৌকাঠই পেরুতে পারেনি। শিক্ষার হার বাড়া সত্ত্বেও খুব জনপ্রিয় জনা দশেক লেখকের লেখা আর খুব প্রয়োজনীয় একাডেমিক কিছু বই বাদ দিলে বেশির ভাগই বড়জোর তিন শ কী পাঁচ শ কপি ছাপা হয়। ওখানে সুসংহত ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজগুলো করা হয়। কপিরাইট, কমিশন, রয়্যালিটি ইতাদির ব্যাপারেও ব্যাপক অস্বচ্ছতা আমাদের প্রকাশনা শিল্পের আজন্ম বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখনো বিদ্যমান। তার মানে, আমাদের প্রকাশনা শিল্পে অরাজকতা না হলেও অস্থিরতা আছে। এসব দূর করতে প্রায় দুই দশক আগে জাতীয় গ্রন্থনীতি ও জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রস্তাবিত নীতিটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে আলাপ-আলোচনা। আলোচনা পর্যন্তই, আর কোনো ফলাফল নেই। প্রকাশনা শিল্পের সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে এ ধরনের অনির্দিষ্ট অবস্থার কারণে। আলোচিত প্রস্তাবিত গ্রন্থনীতিতে গণগ্রন্থাগার ছোঁয়া একেবারে ইউনিয়ন ও গ্রামীণ পর্যায়ে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়। যদিও প্রতিটি উপজেলায় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা আজও সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে আছে বইয়ের মূল্য নির্ধারণে এক ধরনের নৈরাজ্য, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বই ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম; লেখকদের মান যাচাই নিয়ে সংকট। সামগ্রিকভাবে বই ও প্রকাশনার পেশাগত মানের অবনতি হচ্ছে দিন দিন। তাই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, প্রস্তাবিত জাতীয় গ্রন্থনীতি দ্রুত সংশোধনপূর্বক চূড়ান্ত করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ প্রণোয়ন করা খুব জরুরি। এর ফলে জ্ঞান ও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা একটি মর্যাদাকর ও গ্রহণযোগ্য শিল্প হিসেবে দাঁড়াবে বলে সম্বোধন করা যায়। একটি বই পড়া সমাজ গড়ে তুলতে যে ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন তার অভাব হয়তো এ দেশে নেই; কিন্তু ভৌত অবকাঠামোর অভাব খুব প্রকট। আশির দশকে ইউনেসকো এটা শুরু করেছিল। আমাদের ন্যাশনাল বুক ক্যাপাসিটি বাড়ানো প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকরা জানেনই না, জাতীয়ভাবে একটি বইয়ের ভার উন্নত সব দেশেই আছে। সেখান থেকেই এই বই পড়া সমাজ গড়ে উঠতে পারে। বই পড়া সামাজ প্রতিষ্ঠিত হলে ‘অ্যাকসেস অব বুক’ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি, আমাদের প্রকাশকদের একটা বড় অংশের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রতি নতুন আঙ্গিক লাভ করেছে। একাডেমির সীমিত পরিসর ছাপিয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্রন্থমেলা বিস্তারের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রকাশকদের যেমন সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে, তেমনি এ গোটা অঞ্চলে সৃষ্টি হবে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা। কবছর ধরে মেলায় পাঠক সমাগম বৃদ্ধির বিবেচনায় মেলার পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যদিও প্রকাশনার সংশ্রবহীন প্রতিষ্ঠানের মেলায় অংশগ্রহণের সমস্যা রয়েই গেছে। প্রাণপ্রিয় অমর স্বাধীনতা লাভ করা বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে আর একটি নতুন পার্বণ, বইমেলা তথা বই-পার্বণ। তাই জাতীয় গ্রন্থনীতি ও জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি প্রণয়নের জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হলে সমস্যাগুলো দূর করা সহজ হতো। আর্জেন্টিনার বিখ্যাত লেখক হোর্হে লুইস বর্হোসের চিন্তাপ্রসূত এই বাক্যের বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রত্যেক বইয়ের একটি প্রতি-বই আছে। সরলীকরণ করে বলা যায়, যেহেতু চিন্তা প্রকাশিত হয় বইয়ের মাধ্যমে, সেহেতু প্রত্যেক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বইয়ের মাধ্যমে বা আরেকটি প্রতি-বইয়ের মাধ্যমে।

বইকে কেন্দ্র করে প্রকাশক-লেখক-পাঠকের সম্মিলনী হয় ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। এর জন্য সারা বছর সবাই অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক আনন্দ-উৎসাহ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হয়েছে জাতীয় উৎসবে। মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত প্রযুক্তির বহুমাত্রিক বিকাশের ফলে। তবে প্রযুক্তির সঙ্গে মুদ্রিত বইয়ের চিরায়ত ঐতিহ্য যুক্ত করে নতুন দিনের সূচনা করা সম্ভব। ১ ফেব্রুয়ারির বইমেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, স্বাধীন উৎকর্ষে সাহিত্য লালনে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখুক-এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist