আবু তাহের
শব্দদূষণ
প্রলাপ সুরে অপলাপ
আবুল আর বাবুল দুই বন্ধু। মহব্বতের বন্ধু। সকাল সকাল আবুল বড় রাস্তা ধরে দ্রুত পা চালাতে লাগল। চায়ের দোকানে বসা ছিল বাবুল। আবুলকে দেখতেই ডাক দিল, আবুল বাজারে যাস? থমকে দাঁড়ায় আবুল। জি না, বাঁশঝাড়ে যাই না বাজারে যাই। হো হো করে হেসে উঠে বাবুল। ও আচ্ছা, আমি তো ভেবেছিলাম, তুই বাজারে যাস, আচ্ছা তুই বাসায় যা। মিটমিট করে হাসে চায়ের দোকানি কবির হোসেন। কি ব্যাপার কবির ভাই, হাস কেন? তোমরা দুজনেই যে কানে কম শুনো এটা কি তোমরা জান না। আবারও হাসে কবির হোসেন। ডাক্তার দেখাও, বড় ডাক্তার, ঢাকায় গিয়ে দেখাও।
কোনো উপায়ন্ত না দেখে দুই বন্ধু ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখাতে গেল। ডাক্তার বললেন, কী সমস্যা। আমরা দুজনে কানে কম শুনি। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, ঢাকা ছাড়েন। যত তাড়াতাড়ি ঢাকা ছাড়বেন তত মঙ্গল। নয়তো কম শোনা নয়, কদিন পরে শুনতেই পাবেন না। আবুল আর বাবুল পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করল। এটা কেমন ওষুধ! বিষয়টি কী?
আসুন পাঠক আমরাও জেনে নেই, ডাক্তার কেন এই ওষুধ দিলেন। বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’-ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে। ঢাকায় নির্ধারিত মানদ-ের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। সংস্থাটির জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউয়ে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১-এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবেল।
আর এক গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দদূষণের কারণে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়। ফলে শিশুদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আবুল ও বাবুল হয়তো নিস্তার পেয়ে যাবে। তারা গ্রামের লোক গ্রামেই ফিরে যাবে কিন্তু আমরা যারা ঢাকার অধিবাসী তাদের ভবিষ্যৎ কোনদিকে?
ঢাকায় শব্দদূষণের মূলে রয়েছে যানবাহন ও হর্নের শব্দ। তবে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজানো, টাইলস লাগানো ও ড্রিল মেশিনের কারণেও তীব্র শব্দদূষণ হচ্ছে। যার ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার ও বিরক্তির মতো রোগের শিকার হচ্ছে নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা।
ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রোগ্রামের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য শব্দের মাত্রার পাঁচটি ভাগ আছে, এলাকা ভিত্তিতে। আর সেই হিসাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা হলো ৪০ থেকে ৭০ ডেসিবেল। আর পরীক্ষায় দেখে যায় কোথাও কোথাও শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার তিন গুণেরও বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতাল, সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা থাকা উচিত। সূত্র : ডয়েচে ভেলে।
অপদস্থ হওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ মানুষ শব্দদূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে ভয়ংকর যন্ত্রণা সহ্য করে যায়। বর্তমানে শব্দদূষণকে ‘শব্দসন্ত্রাস’ হিসেবে বিবেচিত করা দরকার। সম্প্রতি রাজধানীর ওয়ারীতে বাসার ছাদে উচ্চস্বরে গান-বাজানোর প্রতিবাদ করায় হামলার শিকার হয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। আজকাল অনেকে গায়েহলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, নববর্ষ ইত্যাদি অনুষ্ঠানেও অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করাকে জীবনের অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলেছে। এতে প্রতিবেশীদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হয়, হৃদরোগীদের হৃৎকম্পন বাড়ে, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ শিশুরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে মানুষের কর্মক্ষমতা কমছে এবং গর্ভবতী মা ও শিশুর ওপর এর প্রভাব আরো মারাত্মক।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালায় যে অঞ্চলের কথা বলা আছে, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, দেশে বিভাগীয় শহরগুলো এমনভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে কোনটা আবাসিক, কোনটা নীরব, কোনটা শিল্প এলাকা তা বোঝা যায় না। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদ- বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ- এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদ- বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না।
রয়েছে সরকারের সদিচ্ছার অভাব। বাংলাদেশের অনেক মন্ত্রণালয়, পরিবেশ এবং শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হচ্ছে। হর্ন বাজানো যেখানে সম্পূর্ণ নিষেধ, সেখানে আমরা দেখতে পাই গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকলে বা যানজটে দাঁড়িয়ে থাকলেও অনেক চালক অহেতুক হর্ন বাজাচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশ ইচ্ছা করলেই এটা কমাতে পারে। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে আরো বেশি সক্রিয় ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
মুখে মুখে অনেকেই উন্নয়নের বুলি আওড়ালেও আমাদের ঢাকাবাসীর অবস্থা দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনের সাইডলাইনে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সে (ইপিআই) সূচকের ১৮০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়। আর তাতে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এনভায়রনমেন্ট পারফম্যান্স ইনডেক্স তৈরি করেছে। প্রতি দুই বছর অন্তর এই পরিবেশের মান নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
ইপিআই তৈরিতে বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, পানিসম্পদ, ভারী ধাতুর উপস্থিতি, কৃষি, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, আবহাওয়া ও জ্বালানির মতো ২৪টি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ মানের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৯ দশমিক ৫৬। শুধু বুরুন্ডির অবস্থান বাংলাদেশের নিচে। বাংলাদেশের ওপরের তিনটি দেশ হলো কঙ্গো (১৭৮), ভারত (১৭৭) ও নেপাল (১৭৬)। তালিকায় ৮৭ দশমিক ৪২ স্কোর নিয়ে সবার ওপরে স্থান পেয়েছে সুইজারল্যান্ড। এরপর প্রথম পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, মালটা ও সুইডেন। তালিকায় প্রথম ১৫টি দেশের সবই ইউরোপের। আর যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ২৭তম অবস্থানে।
এই হলো আমাদের ঢাকাবাসীদের অবস্থা। শিগগিরই হয়তো আমরা বধির হয়ে যাব। কোনো কিছুই হয়তো তখন আমাদের কানে ঢুকবে না। যেমন এখন ঢুকছে না প্রশাসনিক লোকদের কানে। আমার জানা নেই তারা কি আমাদের আগেই বধির হলো কিনা। একটা বেরসিক কৌতুক হয়ে গেল। আরেকটি কৌতুক। রাশিয়া যখন সোভিয়েত রাশিয়া ছিল, তখন এই কৌতুকগুলো প্রচলিত ছিল। সোভিয়েতস্কি কৌতুকভ নামে এগুলো প্রচলিত।
এক ক্যাপ্টেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে শুকিয়ে গেছেন। পুরোনো প্যান্টগুলো ঢিলা হয়ে গেছে। তিনি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বারবার প্যান্টটাকে টেনে তুলছেন। এক ভদ্রমহিলা সেটা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছিলেন। তিনি ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে বললেন, বারবার এটা করা কি ভালো হচ্ছে? তখন ক্যাপ্টেন বললেন, আপনার মতে প্যান্টটা ছেড়ে দেওয়াই কি ভালো হবে? আমার মতে, উপায়ন্ত না থাকলে হয়তো তা ছেড়েই দিতে হবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
"