মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

ইসলাম

যৌতুকের বহুমাত্রিক কুফল

বিয়ে মানুষের নীতি ও নৈতিকতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে সন্তান জন্ম লাভ করে। ভবিষ্যৎ বংশধারা সুরক্ষা পায়। যদি এর সূচনা হয় লোভ, অশুচি ও অনৈতিকতার মাধ্যমে, অন্যায় উপার্জনের মধ্যমে, বিয়ের কোনো একপক্ষ বিশেষ করে কনেপক্ষকে বরপক্ষ দ্বারা শোষণের মাধ্যমে তাহলে এই ধরনের বিয়ের মধ্যে পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে না। পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাহীন বিয়ের মাধ্যমে মিলন আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ে ও বিয়েবহির্ভূত মিলনের মধ্যে তফাত শুধু সামাজিক বন্ধন, পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততার। বিবাহবন্ধনের মিলনে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে। আর বিয়েবহির্ভূত মিলনে তা থাকে না।

এ জন্যই ইসলাম বিয়েবহির্ভূত মিলন হারাম করে দিয়েছে। যৌতুকের বিয়ে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে না। সুতরাং ব্যভিচার যদি নিষিদ্ধ হয়, হারাম হয়, অশুচি হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সমাজে ঘৃণিত হয়, তাহলে যৌতুক কেন অশুচি হবে না, হারাম হবে না, সামাজিকভাবে ঘৃণিত হবে না? ব্যভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যদি অপবিত্র হয়, ভালো কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে যৌতুকের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কেন অপবিত্র হবে না, ভালো কাজে নিষিদ্ধ হবে না? মিশকাতুল মাসাবিহের একটি হাদিসের মর্মানুযায়ী ‘ফেরত না দেওয়ার নিয়তে কোনো অর্থপ্রাপ্তির লোভে যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে সে একজন ব্যভিচারী।’ যৌতুকলোভীদের জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কী উদাহরণ হতে পারে?

মানব বংশ রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অবদান। বরং সন্তান লালন-পালনে মায়ের অবদান বেশি। সন্তান জন্মের ক্ষেত্র তৈরি হয় বিয়ে নামক একটি পবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে। আর এই বন্ধনেরই যদি গোড়াপত্তন হয় একটি অন্যায্য অমানবিক শর্ত আরোপের মধ্য দিয়ে, তাহলে এ বন্ধন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান-সন্ততির ওপর যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে তা অনস্বীকার্য। সামান্য অর্থের লোভে পড়ে যৌতুকলোভীরা আল্লাহ তাআলার দেওয়া একটি বিধানের কত ক্ষতি করেছেন। বিয়ে কোনো সওদা বা বাণিজ্য নয়। আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়। এটি একটি পবিত্র বন্ধন। এ দ্বারা এক জোড়া মানব-মানবীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য স্থাপিত হয়। একজন আরেকজনের জন্য হালাল হয়। এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়। বেহেশতি নেয়ামত। এই বন্ধন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন।

যৌতুক চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের চেয়েও খারাপ। চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী যেমন অন্যের মাল জোর করে ছিনিয়ে আনে, যৌতুক গ্রহণকারীও তাই করে। স্বেচ্ছায় কেউ যৌতুক দেয় না। দায়ে পড়েই যৌতুক দেয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো যৌতুক গ্রহণও হারাম। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে পুরুষ নারী অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তাদের যেমন উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, তেমনি নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতাও বেশি। তাই ইসলাম নারী অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নর তথা স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। আর এই কারণে মিরাস তথা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও মেয়ের তুলনায় ছেলের ভাগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই একই কারণে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের আর্থিক সামর্থ্য অর্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে বিলম্বিত করতে ইসলাম পুরুষকে পরামর্শ দিয়েছে। এরূপ বলা হয়নি যে, আর্থিক সংগতি না থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবক থেকে অর্থ নিয়ে বিয়ে করতে হবে। শারীরিক শক্তি অধিক উপার্জন ক্ষমতার কারণে যেখানে আল্লাহ নারীর ওপর নরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেখানে বিয়ের সময় নারীর কাছ থেকে নরের যৌতুক নামক অর্থ আদায় আল্লাহ প্রদত্ত নরের শ্রেষ্ঠত্বেরই অবমাননা। কোরআনের বাণী, ‘পুরুষ স্ত্রীলোকের ওপর নেতৃত্ব পেয়েছে এই জন্য যে, পুরুষরাই পারে নারীকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে।’ (সুরা নিসা : ৩৪)।

এই আক্রমণ শারীরিক হোক, নৈতিক হোক কিংবা আর্থিক। আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে নারীকে রক্ষার জন্য যেখানে পুরুষকে নারীর নেতা বানানো হয়েছে, সেখানে পুরুষ কর্তৃক নারীর কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক আদায় পুরুষের জন্য সত্যি অবমাননাকর ও লজ্জাজনক কাজ। শারীরিকভাবে দুর্বল নারীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে সবল পুরুষের কোনো সুবিধা আদায় পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার পরিপন্থী। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কুফরি বা অস্বীকার করার শামিল। এই ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা হচ্ছে, ‘তোমরা যদি আমার দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর, তাহলে তা আমি বাড়িয়ে দেব। আর যদি অস্বীকার কর, কৃতঘœ হও, তাহলে জেনে রেখো আমার শাস্তি খুবই কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় চরিত্রকে পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখা এবং মনের প্রশান্তি লাভ। যৌতুক নামক টাকা-পয়সার বাধ্যতামূলক লেনদেন বিয়ের পবিত্র উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে দেয়। বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সহানুভূতি, দরদ ও সহযোগিতা সৃষ্টি হয়। আর বিয়েটাই যদি সম্পন্ন হয় যৌতুক নামক তিক্ততার মধ্য দিয়ে, তাহলে এই বিয়ে থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না। অথচ মহান রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘আল্লাহর নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। (সুরা রুম : ২১)। উক্ত আয়াতে বিয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরম পরিতৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি লাভ। বিয়ে যদি আর্থিক লাভ-লোকসানের বস্তুতে পরিণত হয়, তখন এ ধরনের বিয়ে থেকে অর্থ পাওয়া গেলেও এ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রণয়, মায়া-মমতা, দরদ-সহানুভূতির সৃষ্টি হয় না। স্বামীর মধ্যে সব সময় একটি অপরাধবোধ কাজ করে। আর স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রতি একটি ঘৃণাবোধ কাজ করে।

যৌতুক একটি শয়তানি কাজ। এর দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন যৌতুক কারো জন্যই সুখকর নয়। এটি ধর্মীয়, অসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুক গ্রহণকারী সমাজ ও পরিবারের কাছে ঘৃণিত, স্ত্রীর কাছে নিন্দনীয় ও অপমানের, নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী কাজ ও শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী। নারী নির্যাতন, শ্রম শোষণ, পৌরুষের দিক থেকে দুর্বল মনের পরিচায়ক, ব্যক্তিত্বের দিক থেকে লজ্জাজনক। আইন করে এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন সম্ভব কিনা তা বলতে না পারলেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের আলেমসমাজ যদি এর মূলোৎপাটনে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসেন, তাহলেই সম্ভব হবে জাহিলিয়াতের এই অভিশাপ থেকে মুসলিম নারীদের রক্ষা করা। এ দেশের আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখরা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। যৌতুকের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা প্রতিরোধে তারা যথাযথভাবে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুতে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য ও সমাজ সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্য। বিয়ের সময় যদি তারা তাদের এই ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বটুকু হেকমতের সঙ্গে পালন করেন, তাহলে নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার হরণকারী বিয়ের যৌতুকের অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : কলামিস্ট ও ইসলামী গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist