রায়হান আহমেদ তপাদার

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নির্ণয় ন করি

জাতি হিসেবে আমরা বাঙালিরা বড়ই বিচিত্র স্বভাবের। আমরা ঝগড়া করি, কলহ করি, খুনোখুনি, মারামারি সবকিছুই করি নিজেদের মধ্যে। ভিনদেশ, ভিন জাতির প্রতিও আমাদের বৈরিতা আছে, তবে স্বজাতির প্রতিই আমাদের ক্ষোভ-বৈরিতা বেশি! আমাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা খুব সহজে ও তুচ্ছ কারণে ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে যাই; কিন্তু পরে আর এই ঝগড়া নিজেরা মেটাতে পারি না। বড় দীর্ঘ এই ইতিহাসের ক্রান্তিকাল। যেন এর শুরু আছে, শেষ নেই। ক্রান্তিকাল ক্রমেই আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। মাঠে-ময়দান থেকে দূরাগত মাইকে, জননেতাদের বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, সংবাদপত্রের ক্ষুরধার রাজনৈতিক কলামে, অফিস-আদালতে, আড্ডায়, নাটকে-সাহিত্যে, এখনো ইতিহাসের ক্রান্তিকালের বিরামহীন উচ্চারণ অব্যাহত আছে। পৃথিবীতে কত কী অদল-বদল হয়েছে, শুধু সেই বুলি ‘ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যেন সচীন সেনগুপ্তের সিরাজ-উদ-দৌলার ভাঙা রেকর্ড বাজছে ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। বাংলার এই ভাগ্যাকাশ যে কবে নাগাদ দুর্যোগমুক্ত হবে আর কবে আমরা স্নিগ্ধ শ্যামল আকাশ দেখতে পাব, সেটা একটা জটিল ধাঁধা। মোশতাক-জিয়া-সাত্তার-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা গত চার দশকে ক্ষমতায় কতজন এলেন-গেলেন; কিন্তু ইতিহাসের ক্রান্তিকাল কিংবা ‘ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা’ আমরা কারো হাত ধরেই উতরাতে পারিনি। বাংলার আকাশে যে কবে প্রথম ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ শুরু হয়েছিল, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে অনুমান করা যায়, অনাদিকাল থেকেই এখানে দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এত দুর্যোগের পরও কিন্তু দেশটা ধ্বংস হয়ে যায়নি!

দেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ, অতি খারাপ, মারাত্মক খারাপ হয়েছে ও হচ্ছে; তার পরও কিন্তু দেশটা দিব্যি টিকে আছে। এত দুর্যোগের পরও দেশের লোকসংখ্যা কমেনি। পরিবার পরিকল্পনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু, লঞ্চডুবে মৃত্যু, সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ-শোক কোনো কিছুই জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিকে থামাতে পারেনি। অথচ ‘ক্রান্তিকাল’ বা ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ চলছেই। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি দিনকাল খুব খারাপ। চারদিকে উত্তেজনা, মারামারি-কাটাকাটি-ফাটাফাটি, হিংসা, খুন, সন্ত্রাস, দলাদলি, ব্যভিচার ও মৌলবাদী তা-ব। এসবের ফল একটাই দিনকাল খুব খারাপ। এই দিনকাল খুব খারাপ যে কত দীর্ঘ যে কত বড়, তা সম্ভবত কেউ জানে না। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। সমাজে অস্থিরতা, ভয়, আতঙ্ক বাড়ছে। শান্ত-স্বস্তি-স্থিতি সব যেন চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। সবাই কেমন মারমুখী ও আক্রমণাত্মক। ভাই বলেও রেহাই মিলছে না; শালা বলে তেড়ে আসছে। প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেউ কারো বন্ধু নয়; সবাই সবার শত্রু, পথের কাঁটা। সবচেয়ে বড় শত্রুতা ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে। পরস্পরকে দেখে নেওয়ার, শিক্ষা দেওয়ার বিরামহীন প্রতিযোগিতা চলছে তো চলছেই। কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে কথার যুদ্ধ চলছে। এ ভেসে যাবে, ও তলিয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে, বিলুপ্ত হয়ে যাবেÑএমন কথা একে অন্যের বিরুদ্ধে নেতানেত্রীরা বিরামহীন বলে যাচ্ছেন। নির্বাচনের বছরে অবশ্য এ ধরনের কথার লড়াই চলাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর পরও অস্বস্তি কাটছে না। পক্ষান্তরে যারাই ক্ষমতায় গেছেন, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেয়েছেন বা ক্ষমতার আনুকূল্য পেয়েছেন তাদের সিংহভাগের ভাগ্য বদলে গেছে।

উল্লেখ্য, রাজনীতি তাদের অনেকের কাছে জনকল্যাণের আদর্শের বদলে হয়ে উঠেছে বিত্তবৈভব-বিলাসী জীবন লাভের আলাদীনের চেরাগ। সরকারের এমপি-মন্ত্রী বা তাদের খাস লোক হওয়ার সুবাদে রাতারাতি পাল্টে গেছে তাদের অর্থ-বিত্তের চেহারা। সরকারদলীয় আমলা বা তদবিরবাজ মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ফড়িয়ারা ২২টি বছর ধরে দুই হাতে কামিয়েছে। এ চিত্র সারা দেশের মানুষ দেখেছে। রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে যাচ্ছে। অনেক রাজনীতিবিদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা সম্মানের জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পূর্বসূরি রাজনৈতিক নেতারা যে যে দলই করতেন না কেন তাদের মধ্যে একটা আদর্শবোধ ছিল। জনগণের কাতারে থাকার, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার চেতনা ছিল। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে মানুষের কল্যাণে, মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে তারা কাজ করতেন। রাজনীতি করতেন। মানুষের ভাষা বুঝতেন। হাঁড়ির খবর জানতেন। সেই ঐতিহ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী অনেক নেতাও জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ভুলের কারণে। তাদের অতীত গৌরবের প্রতি তারা অবিচার করেছেন যখন যিনি ক্ষমতা পেয়েছেন। রাজনীতির মঞ্চে গণতন্ত্রের নেতারা মূল্যবোধহীন রাজনীতির জন্য সেনাশাসকদের দায়ী করে আসছেন। কিন্তু তারা ভুলেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারা দেখছেন না। জনগণ বারবার তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে হেঁটেছে। বারবার গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছে। কিন্তু গণতন্ত্র মুক্তির পর তারা জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার কি রক্ষা করেছেন? মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ের পথ থেকে রাজনীতিকে টেনে বের করে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস এবং পরমতসহিষ্ণু হয়ে কি হাঁটতে চেয়েছেন? চাননি বলেই রাজনীতিজুড়ে আজ চরম অবক্ষয়।

বিগত জাতীয় নির্বাচনের দুঃসহ সহিংসতার স্মৃতি সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আবার কখন কোন অজুহাতে শুরু হয়ে যায় মহাতা-ব, এই ভয়ে সবাই দমবন্ধ প্রতীক্ষায় আছে! বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের নীতি হচ্ছে, যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে। ওদিকে বিরোধী পক্ষ সরকারকে জব্দ করতে সব ধরনের চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। প্রায় চার দশক ধরে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রত্যেক শাসনামলই ছিল ‘খারাপ সময়’। এক খারাপ সময় অতিক্রম করে আরেক ‘খারাপ সময়ে’ পৌঁছেছি; কিন্তু সুসময় বা সুদিনের দেখা পাইনি। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তখন তারাই অসংযমী ও বেপরোয়া হয়েছেন। ফল সেই একই সাধারণ মানুষের সর্বনাশ। সর্বনাশ হতে হতে এর মাত্রাটা বেড়ে সাড়ে সর্বনাশে গিয়ে পৌঁছায়। সাবধানের মার নেই কথাটা অচল হয়ে গেছে। শত সাবধানতা সত্ত্বেও মার খেতে হচ্ছে। আর তা হবে না-ই বা কেন? যারা আক্রমণকারী, উদ্ধত, সেই সন্ত্রাসীরা তো আর সাবধানী হচ্ছে না। তাদের বেপরোয়া কর্মকা- থামানোর কোনো আয়োজন নেই। সরকার সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। ফলে এসব অপশক্তি নির্বিঘেœ অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ও নিরীহরা সাবধানী হয়েও মার খাচ্ছেন, বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন।

সামান্য একটি গরু কিনতে গেলেও তৃতীয় পক্ষ দালালের সাহায্য নিতে হয়। এই তৃতীয় পক্ষ কালচারের কারণেই এ দেশে শুধু একটা নির্বাচন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করতে হয়েছিল। বিদেশিদের প্রতি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। দেশি রেফারির তুলনায় তাই এখানে বিদেশি রেফারিরা মর্যাদা পায় বেশি। তাদের মান যেমনই হোক। ঢাকার ফুটবল ও ক্রিকেট লিগে নিম্নমানের বিদেশি খেলোয়াড়ের আধিক্য আমাদের বিদেশিদের প্রতি মোহেরই স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। দেশের ঠাকুর ছেড়ে বিদেশের কুকুর ধরতে আমরা বরাবরই অতি-উৎসাহী।

ইতিহাস ঘাটলেও দেখা যায়, বাঙালি বারবার বহিরাগতদের বশ্য মেনে নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিনদেশিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে; কিন্তু নিজেদের মধ্যে কে প্রভু হবে এ নিয়ে মরণপণ লড়াই করেছে। স্বজাতিপ্রীতি অপেক্ষা বাঙালির বিদেশিপ্রীতি সব সময় বেশি বলে মনে হয়েছে। শত্রুকে উচ্ছেদ করতেও বাঙালি বারবার বাইরের লোক ডেকে এনেছে। আসলে বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন সভ্যতার সংঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালির চরিত্রে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য বাসা বেঁধেছে। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই, একতা নেই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি হুজুগে মাতে বটে। এই হুজুগে অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। বাঙালির চরিত্র এমন বৈপরীত্য দিয়েই গড়া। এমন দেশ সত্যিই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে না! সরকারে থাকলে স্বর্গসুখ, বিরোধী দলে গেলে দোজখ বাস! তাই কেউ বিরোধী দলে যেতে চান না। রাজনীতির সংকটটা এখানেই। ক্ষমতার লড়াইয়ে রাজনীতিতে আমজনতা অতি সাধারণ মামুলি তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সংবিধান জনগণকেই ক্ষমতার মালিক বলেছে।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist