ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

ভাবনা

ক্রমেই মারা যাচ্ছে নদী

নদী ও সভ্যতার যোগসূত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দুনিয়ার সব সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীতীরে। এটি যেমন নীল নদতীরের মিসরীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে সত্যি, তেমন দাজলা ফোরাতের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতার জন্যও প্রযোজ্য। এই উপমহাদেশের হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে পাঁচ হাজার বছর আগে সভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছিল তার পেছনে এ দেশের নদ-নদীর অবদান ছিল অনন্য। কারণ প্রাচীন সেই যুগে নদী ছিল চাষাবাদের পানি জোগানোর একমাত্র মাধ্যম। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও মানুষ নদীপথের ওপর ছিল অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশকে বলা হয় নদ-নদীর দান। নদীর পানিবাহিত পলিকণা জমে গড়ে উঠেছে এ ভূখ-। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এ ভূখ- বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হলো এর পানিসম্পদ। সারা বিশ্ব যখন পানি সংকটে ভুগছে তখন আমরা এ সম্পদের উৎস নদ-নদীগুলোর সুরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছি। স্বাধীনতার পর দেশের সার্বিক অগ্রগতি ঘটলেও একের পর এক নদ-নদীর বিলীন ঘটেছে।

একদিকে উজানে পানি প্রত্যাহার, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেওয়া, নদী ভরাট করা এবং দূষণের ছোবল হেনে একের পর এক নদ-নদীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতার আগে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ৭০০, বর্তমানে এ সংখ্যা ৪০৫। তবে বেসরকারি তথ্যানুযায়ী বর্তমানে নদীর সংখ্যা ২৩০। নদ-নদী নিধনের যে যজ্ঞ চলছে তা রোধ করা না গেলে নদ-নদীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে পরিচিতি রয়েছে তা লোপ পাবে। নদী না থাকলে চাষাবাদের জন্য মিলবে না সেচের পানি। পান করার মতো পানির অভাবও প্রকট হয়ে উঠবে। উজানে ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রমত্তা পদ্মা নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। মিঠাপানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন লোনাপানির আগ্রাসনে বিপদাপন্ন হয়ে উঠেছে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠছে। নদী সুরক্ষায় অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যেমন যতœবান হতে হবে, তেমন দেশের নদ-নদীগুলো খনন করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাহলে নদ-নদী রক্ষা যেমন পাবে, তেমনি বৃদ্ধি পাবে মাছের প্রাকৃতিক জোগান। সমৃদ্ধ হবে দেশের কৃষি। রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র। অস্তিত্বের স্বার্থে এ ব্যাপারে যতœবান হওয়াটা আজ সময়ের দাবি।

নদীমাতৃক দেশের ইতিহাস ক্রমেই মøান হতে চলেছে। দেশের নদ-নদীগুলোর অবস্থা যে শোচনীয় তা নদীর সার্বিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে সেসব রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নদীগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে এবং দখল, দূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও চাষের জমি বাড়বে।

নদীর ভূমি উদ্ধারে অতীতে বিভিন্ন উদ্যোগ আমরা দেখেছি। বাস্তবায়নের চিত্র ভিন্ন। বিশেষ করে ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু এই চার নদীর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দখল ও দূষণের মহোৎসব। ভূমিদস্যুদের দখলবাজি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের নির্লিপ্ততা এবং নাগরিক সচেতনতার অভাবে নদীগুলোয় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে পরিবেশবিদরা অভিযোগ করছেন। অবস্থা এমনই যে অনেক নদ-নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর গড়ে দশটি নদী তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ইতোমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে হারিয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি। এর মধ্যে ১১৭টি নদীর মরণদশা ঘনিয়ে এসেছে। এই চিত্র বদ্বীপটির কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদ-নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এখানে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। নদী বাঁচাতে তীরবর্তী জায়গার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ ১২ দফা নির্দেশনা দেন আদালত। নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর অবৈধ জায়গা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দখলমুক্ত করার কথা বলা হয়। নদীকে দূষণমুক্ত করতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। নদীর পারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বনায়ন, পাড় বাঁধানো এবং সর্বোপরি নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে পিলার স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব কাজ দ্রুত করার জন্য বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব নির্দেশ আদৌ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা জানা নেই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নদী নিয়ে যে সমস্যাগুলো আছে তা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে নদীর যেকোনো ধরনের উন্নয়ন ব্যাহত হোক এমনটা প্রত্যাশিত নয়। নদীদূষণমুক্ত করা ও দখল প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সর্বোপরি নদীরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কোনোভাবেই দেশের পরিবেশ, প্রতিবেশকে আর হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া যাবে না। দ্রুত খননের কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। কারণ নদী বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।

লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist