ইয়াসমীন রীমা
বিশ্লেষণ
অপরিণত বিয়ে : শিশুমৃত্যু বাড়ছে
বিয়ের আড়াই মাসের মধ্যেই সেলিনা (১৪) জানতে পারেন তিনি মা হতে চলেছেন। প্রসূতির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে সন্তান প্রসব হলো, তখন কোনো মতে মা প্রাণে বেঁচে গেলেও নবজাতক শিশুকে বাঁচানো গেল না। ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রায় ২০ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায় গাইবান্ধা জেলা সদরের বিশোরী মা সেলিনার নবজাতক শিশুটি।
দেরিতে গর্ভধারণের ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর অসাবধানতার কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়েন মমতা (১৫)। শুরু থেকেই গর্ভকালীন নানা রকম জটিলতায় ভুগতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়ে থাকেন কিছুদিন। মমতার প্রসব হলো মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মমতা বেঁচে গেলেও ধীরে ধীরে খারাপ হতে লাগল তার নবজাতকের অবস্থা। মাত্র দুদিনের মাথাই নওগাঁ সদর হাসপাতালে মারা গেল শিশুটি। এভাবেই দেশের কিশোরী মাদের নবজাতক শিশুরা মারা যাচ্ছে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের কারণে গর্ভকালীন জটিলতা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে বেশির ভাগ কিশোরী মায়ের নবজাতক শিশুর করুণ মৃত্যু ঘটছে।
উল্লেখ্য, দেশে সামগ্রিকভাবে শিশুমৃত্যুর হার কমার জন্য ৬৫তম জাতিসংঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুরস্কৃত হয়েছে। তবে কিশোরী মায়ের নবজাতক শিশুমৃত্যুর হার বাড়ার কারণে তুলনামূলক সামগ্রিক শিশুমৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) স্বাস্থ্য ও জনমিতিক জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২০ হাজার নবজাতক মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই কিশোরী মায়ের শিশু। কিশোরী মায়ের এসব শিশুর ৫০ ভাগ মারা যাচ্ছে জন্মের ২০ ঘণ্টার মধ্যে, ৫৪ ভাগ মারা যাচ্ছে জন্মের দুদিনের মধ্যে। আর প্রতি ৯টি শিশুর মধ্যে একটি শিশু মারা যাচ্ছে পাঁচ বছর বয়সের আগেই। জরিপে বলা হয়েছে, গত এক দশকে দেশে মাতৃমৃত্যু এবং সামগ্রিক শিশুমৃত্যুর হার কমলেও নবজাতক শিশুমৃত্যুর হার মোটেও কমেনি, বরং বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী অপুষ্টিজনিত কারণে দেশে প্রতিদিন ৬০০ শিশুর মৃত্যু ঘটছে, যার প্রায় ৭০ ভাগই কিশোরী মায়ের শিশু। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশে বছরে ৩৩ লাখ ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হয়। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১১ লাখ ১০ হাজার শিশু স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ১১ ভাগ এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৪৬ ভাগ কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার। পরিবার কল্যাণ অধিদফতরের এক তথ্য মতে, গ্রামের ৮৫ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীদের বিয়ের গড় বয়স ১৬.৯ বছর। এসব কিশোরীর শতকরা ৫৯ ভাগ বিয়ের পর পরই মা হয়ে পড়েন।
রিপোর্টের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়ের সংখ্যাই বেশি। প্রায় দুই দশক ধরে এ হার অপরিবর্তিত রয়েছে।
ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, প্রতি বছর বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৮ কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। এই কিশোরী মাদের প্রায় ৩৫ লাখ শিশু প্রতি বছর মারা যায়। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম।
দেশের প্রখ্যাত প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরার মতে, কিশোরীর শারীরিক কাঠামো গর্ভধারণের উপযুক্ত নয়। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করলে কিশোরী মায়ের শরীরের ওপর চাপ পড়ে। এতে মা ও নবজাতক উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। কিশোরী মায়ের প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় চার গুণ বেশি। তিনি বলেন, সেলিনা ও মমতার মতো কিশোরী মায়ের নবজাতকের মৃত্যুর হার কমাতে হলে অবশ্যই বাল্যবিবাহ কমাতে হবে। এজন্য তিনি অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানো, মেয়েদের শিশুর শিক্ষার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন। সরকারের কৈশোর প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক বলা হয়েছে, পুষ্টিহীনতা কিশোরী মায়ের নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। দেশে বর্তমানে ৩৯.৪০ ভাগ কিশোরী চরম অপুষ্টির শিকার।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. কামরুন নাহার বলেছেন, কিশোরী বিবাহের দুটো বড় কারণ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং যৌতুক। কিশোরীর নিরাপত্তার অভাবে অনেক সচেতন মা-বাবাও অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। আবার মেয়ের বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবেÑএমন ধারণা থেকেও মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মেয়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কিংবা তার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবা হচ্ছে না। তিনি বলেন, শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করতে হলে কিশোরীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ও যৌতুক লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক তথ্যে দেখা যায়, কিশোরী মাদের শতকরা ৬৯ ভাগই প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞ। এদের মধ্যে ৪১.৮০ ভাগ পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করেন।
প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোমেনা খাতুন বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে কিশোরী মায়েদের স্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ মা হওয়ার জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। ফলে গর্ভধারণের আগে থেকে মা হওয়া পর্যন্ত কিশোরী মা ও নবজাতক ভারসাম্যহীন ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা বেঁচে গেলেও নবজাতককে বাঁচানো যায় না। তার মতে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অভিভাবক ও কিশোরীদের সচেতন করে তুলতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, কিশোরী মায়ের শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের আগে কিশোরীর বিয়ে বন্ধ করতে হবে। এ জন্য তিনি দায়ী করেন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯৮৩ এবং যৌতুকবিরোধী আইন-১৯৮০-এর প্রয়োগ না থাকাকে। এ ছাড়া সর্বজননীন পারিবারিক আইন না থাকায় কিশোরীর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকেও তিনি কিশোরী বিয়ের জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালুর পরও কিশোরী বিয়ে কমছে না। এ জন্য তিনি কিশোরী মায়ের শিশুমৃত্যুর ভয়াবহতা তুলে ধরে ব্যাপক সচেতনতার লক্ষ্যে প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। অন্যথায় শিশুমৃত্যুর হার-সংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে।
লেখক : সাংবাদিকও কলামিস্ট
"