মো. কায়ছার আলী

  ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

ভোট

কিশোর উঠোনে নির্বাচনী উৎসব

‘বন্ধু তোমার একটি ভোটে, যোগ্য প্রার্থী যাবে জিতে’, ‘নাবিলার দুই নয়ন, আদর্শ স্কুলের উন্নয়ন’, ‘ভোটে এসেছি প্রথমবার, পাশে চাই আমি সবার’। লাল, কমলা, হলুদ কাগজে হাতে লেখা এ রকম শত শত রঙিন পোস্টারে দেশের ১০৪৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমমানসহ (৪৯৫টি মাধ্যমিক, ৪৮৭টি মাদরাসা, ৬১টি কারিগরি) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ৮ আগস্ট ২০১৫ শনিবার স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত ২১ মার্চ ২০১৬ সোমবার দেশব্যাপী দ্বিতীয়বারের মতো অবশিষ্ট মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো ৩০ মার্চ ২০১৭ বৃহস্পতিবার সারা দেশে স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৮ বছর বয়সের আগেই সরকার তাদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটাধিকার দেওয়ার জন্য সত্যিই তারা আনন্দে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে ভাসছে। আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তিই হলো নির্বাচন এবং নাগরিক বা জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। নির্বাচন হলো জনমত প্রকাশের প্রধান ও বিধিসম্মত প্রক্রিয়া এবং এর দ্বারাই প্রতিনিধি বাছাই করে তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অবস্থাভেদে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুতরাং নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র চলতে পারে না। গণতন্ত্র অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে গ্রহণযোগ্য সাধারণরা একসময় বিজয়ের মুকুট পরতে পারবে, এটাই নিয়ম। এ দেশের আগামী নিকট ভবিষ্যতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল বা ছাত্রসংসদ নির্বাচনে বিজয় আনার ঘ্রাণ পাচ্ছি। আমাদের এ দেশে অনেক ছাত্রনেতা দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তৈরি হয়েছেন। আন্দোলন, সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ সংক্ষেপে ডাকসু (জন্ম ১৯২৪ সালে সর্বশেষ নির্বাচন ১৯৯০ সালে)। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার। পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ ও জাতি যোগ্য নেতা বা নেতৃত্বের কারণে উন্নতি লাভ বা স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

এবার দেশের ২২৬৪৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জানুয়ারি ১৬০৮৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ২৯ জানুয়ারি ৬৫৫৭টি দাখিল মাদরাসা। এ নির্বাচনে ১৮১১৫২টি পদের জন্য ২৮৩৩৩৯ শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোট দিয়েছেন ১০৩৮৪৩৪৮ জন শিক্ষার্থী। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, হানাহানি, জাল ভোটের দৌরাত্ম্য অথবা পরাজিত প্রার্থীরা নির্বাচন বয়কট করেনি। ভোটার উপস্থিতি ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ, ভোট গ্রহণ চলেছে সকাল ৯টা থেকে একটানা বেলা ২টা পর্যন্ত। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এবং ২০১৮ সালেও বড়দের মতো ভোট দিতে পেরে তারা বেশ আনন্দিত এবং গর্বিত। আমিও আনন্দিত এ জন্য যে, এ নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশনার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার এবং আইনশৃঙ্খলা দায়িত্ব পালন করেছে কিশোর-কিশোরী বয়সের ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য এবং অভিভাবকরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন। নির্বাচনে মুদ্রিত কোনো পোস্টার ও প্রতীক ব্যবহার করা হয়নি। ছাত্র পরিষদ গঠনের নীতিমালা অনুযায়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছেন ভোটার। তারা এ পাঁচটি শ্রেণি থেকে (প্রতি শ্রেণিতে কমপক্ষে ১ জন´৫=৫ জন এবং সর্বোচ্চপ্রাপ্ত ভোট তিনজন) আটজন প্রতিনিধি সরাসরি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছাত্র পরিষদের প্রথম সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে (স্টুডেন্টস কেবিনেট) প্রথম সভা করবে। এ পরিষদকে বলা হবে ছাত্র পরিষদ। ছাত্র পরিষদ প্রধানকে বলা হবে প্রধান প্রতিনিধি। তারা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাত দিনের মধ্যে সভা করে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন এবং প্রথম বছরের কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। কেবিনেটের মেয়াদ হবে ১ বছর, প্রতি বছর কেবিনেটের নির্বাচন হবে। তারা প্রতি মাসে অন্তত একটি সভা করবে। কেবিনেট প্রধান সভায় সভাপতিত্ব করবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেবিনেটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা, পরামর্শ এবং দায়িত্ব বণ্টন করে দেবেন।

তাদের প্রধান দায়িত্ব ও সম্পাদিত কর্মকা- হলো পরিবেশ (বিদ্যালয় আঙিনা ও টয়লেট পরিষ্কার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) পুস্তক এবং শিখনসামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানিসম্পদ, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন, বৃক্ষরোপণ ও বাগান তৈরি, দিবস পালন ও অনুষ্ঠান সম্পাদনা এবং আইসিটি। নিকট অতীতে অর্থাৎ ২০১০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে বাছাই করা ১০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো এবং ২০১১ সালে ৭৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে তৃতীয়বারের মতো ১৩,৫৮৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের প্রতি গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা নিদর্শন, বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকম-লীকে সহায়তা, ১০০ ভাগ ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধ, শিখন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অভিভাবকের সম্পৃক্ত করা, বিদ্যালয়ের পরিবেশ কর্মকা-ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও নির্বাচনের আয়োজন করা। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে তৃণমূল পর্যায়েও কাজ করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এ নির্বাচন। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম বিকশিত হয় মানুষের মনে, পবিরারে, গোষ্ঠীতে, স্থানীয় পর্যায়ে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তা কার্যকর হতে হতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। বর্তমান পৃথিবীতে এ মতবাদই শ্রেষ্ঠ। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদিও প্রায় ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যায়, আবার অন্যদিকে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতার বাইরে থাকে। তবু এ গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রতিনিধিরাও গণতন্ত্রকে ভালোবাসে এবং পরে নির্বাচনের মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে মূল্যবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। মূল্যবোধ হলো ঐরফফবহ ঞৎবধংঁৎবং এবং টহরাবৎংধষ-এর তিনটি স্তর আছে ইবষরবভ, চৎড়সড়ঃব ধহফ চৎধপঃরপবং। আমরা প্রথম দুটো নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করি কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তৃতীয় টিআর তা নিয়ে চুপ থাকি, যা বর্তমান সরকার চালু করেছেন। এ জন্য বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে অবশ্যই ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাই। মূল্যবোধ মহীরুহের মূল শেকড় হলে সততা ও নৈতিকতা। যার জন্ম হয় পরিবারে আর পরিচর্যা পেয়ে বড় হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গনে এবং বলবান হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের বহমান আলো ও বাতাসে। স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আশা করছেন, এ প্রজন্মকে দিয়ে আগামীতে সব মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নৈতিক চাপে রাখতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আইন থাকায় তারা নানা প্রতিকূলতার কারণে নির্বাচন দেওয়ার সাহস পায় না। তিনি বলেন, আমরা তাদের কাছে অনুরোধ করতে পারি কিন্তু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারি না। তিনি গণতন্ত্রকে তৃণমূল থেকে বিকশিত বা সহনশীল করার জন্য যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তার জন্য আবারো ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয় হয়েছিল প্রথমে এক পা ফেলে, বড় স্থাপত্য তৈরি করেছিল একটি ইট থেকে, বড় বাগানটি শুরু হয়েছিল একটি বীজ থেকে। সুতরাং কারো জন্য অপেক্ষা না করে পথ চলতে হবে, হাজার হাজার মাইলের পথ। পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ, কাঁটাযুক্ত, আঁকাবাঁকা পিচ্ছিল গণতন্ত্রের পথ। গণতন্ত্র সৌন্দর্যের পূজারি, ভিন্ন মত অলংকার। এ কথা বাস্তবে

রূপ লাভ করুক সর্বত্র। যদিও ছাত্র রাজনীতি বর্তমান অবস্থা ধূসর তবে এর সোনালি অতীত আবারো ফিরে আসতে শুরু করেছে ছোট্ট সোনামনিদের বা কিশোর-কিশোরীদের দিয়ে এবং আমরা আশাবাদী।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist