অলোক আচার্য
মতামত
দুঃসাধ্য তবে অসাধ্য নয়
বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় কাঁটা নেশা। আর নেশার উপাদানের মধ্যে মাথাব্যথার বড় কারণ ইয়াবা, যা নেশাগ্রস্তদের কাছে ‘বাবা’ নামে পরিচিত। ইয়াবার নেশায় আজ দেশের যুবসমাজ বুঁদ হয়ে রয়েছে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এর বিস্তার এতটাই ভয়াবহ যে সামনে কোনোভাবেই এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মাদকদ্রব্যই যদিও সমস্যার মূল কারণ কিন্তু ইয়াবা এত অল্প সময়ে এত ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছে যে অন্যসব মাদক গ্রহণ এর কাছে যেন নস্যি। ইয়াবার আকার, রং এবং সমাজের উঁচুস্তরে ব্যবহার ইয়াবার জনপ্রিয়তার বড় কারণ। হাত বাড়ালেই শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল সব জায়গায় ইয়াবা মিলছে। আর আকারে ছোট হওয়ায় এর বহনও সহজ। প্রায়ই চোরাইপথে এমন সব অভিনব উপায়ে ইয়াবার চালান আটক হয় যে তা পত্রিকার পাতায় পড়লে রীতিমতো শিহরণ জাগে। ইয়াবার ব্যবসায় প্রায় সব শ্রেণিপেশার লোক জড়িত রয়েছে। অল্প সময়েই টাকার পাহাড় গড়া যায় বলেই এই ব্যবসায় এত আকর্ষণ। কোটি কোটি টাকার পাহাড়, আলিশান বাড়ি, দামি গাড়ির লোভ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে ইয়াবার ব্যবসায় নামাচ্ছে। এটা এমন একটি চেইন যেখানে ওপর থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত মাদকাসক্তের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। তার খুব কম পরিমাণই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। তা ছাড়া প্রতিদিন জড়িত হচ্ছে নতুন নতুন ব্যক্তি। আর প্রতিদিন আসক্ত হচ্ছে কোনো কিশোর বা যুবক। ইয়াবার বিষ এতটাই ভয়ংকর যে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করাটা দুঃসাধ্য বলে মনে হচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইয়াবা সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করতে সক্ষম। মাদকে ঘিরে ফেলছে সমাজ। প্রতিটি স্তরের নারী-পুরুষই মাদকে আসক্ত। এত এত সচেতনতা সত্ত্বেও কিন্তু এর ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। নিত্যনতুন মাদকের আবির্ভাব ঘটছে। বিড়ি, সিগারেট, জর্দার তামাক পাতা, গাঁজা, ফেনসিডিল, ভাং থেকে শুরু করে হালের ইয়াবা এখন শহরের গ-ি পেরিয়ে গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঢুকে কালো থাবা বিস্তার করে বসেছে। যার প্রভাবে শিক্ষিত তরুণসমাজ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সর্বনাশা মাদকের দিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ছাত্রসমাজ। অনেক ছাত্রের স্কুল ব্যাগে বই-খাতার সঙ্গে থাকছে মাদকদ্রব্য। এমন কোনো পেশা নেই যে বা যারা ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে না। ভয়টা এখানেই বেশি। যাদের অন্যদের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালন করার কথা তারাই এই পথে পা বাড়াচ্ছে। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে লেখা থাকে। টিভিতে নেশাজাতীয় কোনো পদার্থের দৃশ্য এলেও এর ক্ষতিকরের দিকটা লেখা থাকে। এটা দেখেও কিন্তু সবাই সিগারেট, মদ খায়। পরিণতি জেনেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা কেন। আজকের দিনে শিশুরাও বিড়ি-সিগারেট কিনে খাচ্ছে। যে কেউ হাত বাড়ালেই পাশের কোনো দোকান থেকে কিনতে পারছে ইয়াবা। প্রশাসন প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইয়াবার থাবা কমাতে কিন্তু শর্ষের মধ্যেই বহু ভূত লুকিয়ে আছে। আছে ওপর মহলের চাপ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবনে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে এই ইয়াবা। কত সংসার ভেঙে যাচ্ছে এই ইয়াবার জন্য। কত মা-বাবার সঙ্গে আদরের সন্তানের বিচ্ছেদ ঘটছে ইয়াবার জন্য। হালের এই মাদকটি সত্যিই দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অন্ধকার থেকে কেউ কেউ বের হতে পারলেও বেশির ভাগই সেই অন্ধকারেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই অন্ধকার থেকে তাদের গন্তব্য হচ্ছে কারাগার, রাস্তায় মৃত্যু অথবা বেঁচে থাকলে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ান। আজ পর্যন্ত এটাই হয়েছে।
মাদকাসক্তের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা। কারণ জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইয়াবাই এখন এগিয়ে। এর বিস্তার এত ভয়ংকর আকারে হয়েছে যে তা শিক্ষার্থীর ব্যাগে পর্যন্ত স্থান করে নিয়েছে। মাদকে আসক্ত কেন হয়। কেনই বা তারা বই-খাতা-কলম ছেড়ে মাদকের মতো সর্বনাশের পথে পা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। কোনো অন্যায় প্রতিরোধে আইন যথেষ্ট নয়। আইনের সঙ্গে সচেতনতা মিলে রোধ করা সম্ভব একটি অপরাধকে। একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। তারপর সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় আমাদের গ্রামেগঞ্জে ছোট ছেলেদের মাদকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে পরিবারের সদস্যদের হাত ধরেই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। প্রথম তামাক জাতীয় নেশা সেখানেই প্রত্যক্ষ করে। হাতের নাগালের মধ্যেই সেগুলো থাকে। আমাদের দেশে গ্রামেগঞ্জে এমনকি শহরে খুব প্রচলিত তামাকজাতদ্রব্য হলো বিড়ি বা সিগারেট, জর্দা (যা বেশির ভাগ পরিবারের নারী-পুরুষই পানের সঙ্গে খায়), ও গুল। এসব এতটাই সহজলভ্য ও হাতের নাগালে থাকে যে ইচ্ছা করলেই এসব কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা তা পরখ করতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা এই সময়টাতে থাকে কৌতূহলী। যেকোনো জিনিসের প্রতি থাকে অদম্য কৌতূহল। এভাবে আনতে আনতে এবং তা বাড়িতে কাউকে খেতে দেখে সেও তা মুখে নেয়। দেখা যায় প্রথমে কৌতূহলবশত অনেকেই শিশু বয়সেই মাদকের সংস্পর্শে আসে।
ইয়াবার আকর্ষণীয় ছোবলে আজ ধ্বংসের অনেক কাছে পৌঁছে গেছে দেশ। প্রতিদিন পাচার হয়ে দেশের ভেতর ঢুকছে ইয়াবা। ইয়াবার কারণে কত ছেলে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে তার হিসাব কে রাখে। কত ভাই তার বোনের স্নেহ থেকে দূরে গেছে তারও হিসাব নেই। সেসব হিসাব রাখাও সম্ভব নয়। তবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ দুঃসাধ্য কিন্তু অসাধ্য নয়। তবে এর জন্য কেবল প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে বসে থাকলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ইয়াবা তথা মাদকের বিরুদ্ধে সচেষ্ট হতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এসব মাদকের কুপ্রভাব বোঝানোর মাধ্যমে। তারা যেন কোনোভাবেই কোনো বন্ধু বা অন্য কোনো উপায়ে অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে ইয়াবা আসক্ত না হয় পরিবারের সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কোনো কাজ যত চ্যালেঞ্জেরই হোক না কেন তা চেষ্টা করলে করা সম্ভব। ইয়াবার বিস্তার বন্ধ করা দুঃসাধ্য কিন্তু অসাধ্য নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"