রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা

২৯ ডিসেম্বর থেকে ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে সরকারবিরোধী যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস উৎখাতের পরও সেখানে সংকট কাটেনি। ট্রাম্পের জেরুজালেম-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ইরানে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হলো। এ ইরানি বিক্ষোভের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় ইরানে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখার জন্য তৈরি থাকতে বলেন! এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট কোনো মেসেজ দিলেন কি না, তা স্পষ্ট না হলেও এটা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে ইরান নিয়ে তিনি নানা মন্তব্য করেছেন। ২০১৫ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে ছয় জাতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা তিনি মানবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এখন এ বিক্ষোভের সঙ্গে ট্রাম্পের টুইট বার্তাকে অনেকে মিলিয়ে দেখতে পারেন। এরই মধ্যে ইরানে বিক্ষোভে মারা গেছেন ২২ ব্যক্তি। সরকার সমর্থকরাও বিক্ষোভ দমনে মাঠে নেমেছেন। সরকার সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এমনকি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিও বলেছেন, ইরানের সাম্প্রতিক এ বিক্ষোভে শত্রুপক্ষের ইন্ধন ছিল। যদিও তিনি কোনো দেশ বা কোনো পক্ষকে ‘শত্রুপক্ষ’ হিসেবে উল্লেখ করেননি। তবে ইরানি জনগণ ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই শত্রুপক্ষ হিসেবে মনে করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে তিনি ইরানের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

এমনকি তিনি গোপনে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনিকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। খামেনি এর জবাবও দিয়েছিলেন। ফলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। নিঃসন্দেহে এ সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরানকে বলা হতো পারস্য অঞ্চলের পুলিশ। অর্থাৎ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত ইরান। রেজা শাহ পাহলভি ছিলেন তখন ইরানের রাজা। ইরানি বিপ্লবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর দীর্ঘদিন ইরান আঞ্চলিক রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলে ইরানি প্রভাব বাড়ছে। ইরান ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। সিরিয়ার আসাদ সরকার ও লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকেও ইরান সাহায্য করছে। ইরান সৌদি রাজবংশকে উৎখাত করতে পারে, তখন একটা আশঙ্কা সৌদি রাজপরিবারে তৈরি হয়েছিল। ইরানের এ ভূমিকাকে সৌদি যেমন পছন্দ করছে না, ঠিক তেমনই পছন্দ করছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলও। ফলে এ অঞ্চলে সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল একটি অলিখিত অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে ইরানের বিরুদ্ধে। ইরানি বিক্ষোভ এখন ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তিকেও প্রশ্নের মুখে রাখল। এ চুক্তির ভবিষ্যৎ কী, তা-ও এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। বলা ভালো, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিটি তখন থেকেই প্রশ্নের মুখে আছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ইরান চুক্তিটি ঠিকঠাক মানছে না। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি এটা নিশ্চিত করেছিলেন ওই চুক্তিটি তিনি মানবেন না।

এরই ধারাবাহিকতায় তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২১ মে রিয়াদে তিনি যখন আরব-আমেরিকান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, তখনো তিনি তার এ ইরানবিরোধী মনোভাব আবারও স্পষ্ট করেছিলেন। রিয়াদে তিনি বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাস ছাড়ানোর জন্য ইরান দায়ী! ফলে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা তখন থেকেই বড় প্রশ্নের মুখে আছে। বলা ভালো, ২০১৫ সালের ওই সমঝোতা চুক্তিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না। তাদের পরমাণু কেন্দ্রে চলবে নজরদারি। অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে এবং তেহরান শর্ত ভাঙলে ৬৫ দিনের মধ্যে ফের কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল হবে। একই সঙ্গে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কতটা এগিয়েছে, তা তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ। ফের আইএইএ ইরানবিরোধী হলে তা মেটাবে একটি সালিশি বোর্ড। এ চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরানকে ফেরত দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার করার ফলে ইরান তার যাত্রীবাহী বিমান সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ বছর পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরো গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করতে পারবে। কিন্তু এর পরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য ওই চুক্তিটি উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করার কথা।

ইসরায়েলি প্রশাসনের প্রচন্ড একটা চাপ থাকা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন এ ধরনের শর্তে রাজি হয়েছিল। ফলে আলোচনায় বাকি বৃহৎ শক্তিও রাজি হয়েছিল। ওবামার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার এবং প্রায় ১০০ জন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক ওবামাকে সমর্থন। কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখেও তিনি এ সমঝোতাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন যদিও পরবর্তী সময়ে ১১টি ইরানি কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইরানবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলারের একটি আন্তচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। রিয়াদ ঘোষণায় ৩৪ হাজার সেনাবাহিনীর একটি বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়েছিল। ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আংশিক উঠে গিয়েছিল; কিন্তু নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে। ইরানের অবস্থা অনেকটা ফাঁদে পড়ার মতো। ইরান পুরোপুরিভাবে মুক্ত হচ্ছে না! নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে আছে। বলতে দ্বিধা নেই, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরিভাবে উঠে গেলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা ইসরায়েল ও সৌদি আরব কারোই পছন্দ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরায়েল। পারমাণবিক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছিলেন, এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল। ইসরায়েলের নীতিনির্ধারক কদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। ফলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে এ অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির কর্মসূচি বাতিল করার দাবি-সংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এ-সংক্রান্ত আরো ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এ ছয় জাতি আলোচনা আরো গতি পায়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং ২০১৫ সালের এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ছয় জাতি উপনীত হয়। ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এ খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছিল; আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ সম্পর্ক আরো উন্নত করার প্রয়োজন ছিল। তাই স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয়, ইরানের অভ্যন্তরীণ এই আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের হাত রয়েছে।

লেখক : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist