সাদিকুর সাত্তার আকন্দ

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্প প্যারাডক্স ও বৈশ্বিক মেরুকরণ

বিগত কয়েক বছর আগেও বিশ্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমেরিকার মুখাপেক্ষী ছিল। এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের কূটনৈতিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে এখনো এটা স্পষ্ট, ওই অঞ্চলের দেশগুলো নিজেরা পশ্চিমাদের তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার হয়ে থাকতে চায়। এমনকি অন্য রাষ্ট্রগুলোও পশ্চিমাদের অনুসরণ করুক এটা চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববাসী কি এখন মার্কিনিদের কর্তৃত্ব ও নাক গলানো পছন্দ করছে? এমন প্রশ্ন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, মন্তব্য ও বক্তব্য যেগুলো উক্ত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে অনেকটাই স্পষ্ট হয় বিশ্ব এখন কোনদিকে ঝুঁকছে। সাম্প্রতিক জেরুজালেম ইস্যুতে বিশ্ব দরবারে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প প্যারাডক্স ছিল চরমে। নিজ দেশের প্রশাসন সাজানো থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিতর্কিত মন্তব্য ও পদক্ষেপ নিয়ে প্যারাডক্স পাহাড় গড়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সমালোচনা পিছু ছাড়েনি ট্রাম্পের। সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্কৃকীতি দেওয়ার মাধ্যমে নতুন সমালোচনার মধ্যে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে কেন ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করতে পারে না? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মানবিক ও অন্যটি আইনগত দিক রয়েছে। আইনগত দিক থেকে বললে, পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলের বসতি স্থাপন প্রকল্প আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ বলে বিবেচিত। জাতিসংঘ একাধিক প্রস্তাবে নিশ্চিত করেছে, চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ইসরাইলের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়াটি বেআইনি। ওই আইনে বলা হয়, কোনো দখলদার দেশ অধিকৃত ভূমিতে তার দেশের নাগরিকদের স্থানান্তর করতে পারবে না। মার্কিন স্বীকৃতির কারণে জেরুজালেম ইসরাইলি নাগরিকদের জন্য একটি অভয়াশ্রয়ে পরিণত হবে এবং সেখানে ইসরাইলি নাগরিকদের বসবাসের জন্য সুবিধাজনক হবে। এতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত আরো গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন ও ট্রাম বিশ্ববাসীর আস্থার জায়গাটি নষ্ট করেছে চরমভাবে।

মার্কিনবিমুখ রাষ্ট্রগুলো চীন বা রুশ অনুসারী হয়ে পড়বেÑএমনটা হরহামেশায় উঠে আসছে রাজনীতি বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে। চীন বা রাশিয়া বিশ্ববাসীর সমর্থন পাবে অদূর ভবিষ্যতে। কারণ মুসলিম বিশ্বের একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের নাম সবার আগে আলোচনায়। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ইদানীং ভালো। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে তুরস্কের। এদিকে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক দহরম-মহরম। চীন-পাকিস্তান-তুরস্ক রাশিয়া সবাই আবার মার্কিনবিরোধী। সুতরাং এটা স্পষ্ট, পাকিস্তানকে বাদ দিলেও অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও রাজনীতির দূরদর্শিতায় চীন, তুরস্ক ও রাশিয়া একত্রে একটু বেশিই অগ্রগামী বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে ধরনের ভারত্ব ও স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজন তা বর্তমান বিশ্বায়নের রাজনীতিতে শি জিন পিং, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ভøাদিমির পুতিনের মধ্যে লক্ষণীয় বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

আগামী দিনের বিশ্ব রাশিয়ার নেতৃত্ব মেনে নেবে অথবা চীনের নেতৃত্বকে সোভনীয় মনে করবে এর পেছনে কিছু সফ্ট কারণ নীরব ভূমিকা পালন করবে বলে অনেকে মনে করেন। যেমন : রাশিয়া বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অতটা আগ্রামী বা বেপরোয়া হয় না, যতটা না যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের রাজনৈতিক ইস্যুতে বেপরোয়া হয়। এটা রাজনীতিতে রুশদের একটি দূরদর্শী চিন্তা প্রতিফলন বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বর্তমানে বেশ আলোচিত, চীন রাজনীতির সঙ্গে তাদের দেশীয় অর্থনীতির একটি সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলেছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতিই বিশ্ব অর্থনীতিতে আগোয়ান ও অগ্রগামী। ২০১৬ সালের জি-২০ সম্মেলনের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চীন হর্তা-কর্তাদের মন্তব্য ও বক্তব্যের সুরে এটা স্পষ্ট হয়, অদূর ভবিষ্যতে চীনই বিশ্ব নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটা বড় ফ্যাক্টর হবে। আর চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই হয়তোবা চীনকে গুরু মানতে শুরু করবে। ৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ৫০-এর দশকের প্রথম দিকের সময়টায়ও চীন অর্থনৈতিকভাবে কম শক্তিশালী ছিলÑএমনটা বলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ওই সময়ে চীন বিশ্ব নেতৃত্বে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যতটা হাল আমলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হলো তখনকার সময়ে চীন তাদের বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে বিশ্বময় পরিব্যপ্ত করতে পারেনি। বর্তমানে স্থিতিশীল অর্থনীতি চীনের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও গতি সঞ্চয় করেছে ব্যাপকভাবে। কালের আবর্তে চীন এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে, সামরিক শক্তিকে কীভাবে জোরদার করা যায় অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে। বিজ্ঞানের ভাষায় তাপ শক্তিকে যেমন অন্য যেকোনো শক্তিতে রূপান্তর করে জীবনকে সহজ করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় তেমনি অর্থনৈতিক শক্তিকে অন্য যেকোনো শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে সময় একটি বিবেচ্য বিষয়। চীন সেটি বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

চীন বা রাশিয়া যদি বিশ্ব রাজনীতিতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্কের প্রভাব একটু বাড়বে, এটা সহজেই অনুমেয়। স্বাভাবিকভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চীন-রাশিয়া-তুরস্কের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা গলায় গলায়। সে জায়গাটায় চিন্তা করতে দেখা যায়, তুরস্কের সাংস্কৃতিক আচরণ ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও তারুণ্যবান্ধব। সুতরাং তুরস্কের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে অতটা বেগ পেতে হবে না অদূর ভবিষ্যতে। তুরস্কও হয়তোবা যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য কাউকে বিশ্ব নেতৃত্বে দেখতে চায়। আর রাশিয়া-চীনই এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে এমনটাই তুরস্কের আচরণে লক্ষণীয়।

বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু রাশিয়া-চীন বিশ্ব নেতৃত্বে এলে পাকিস্তানও একটু মুচকি হাসবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সম্পূর্ণই বৈরী। পাকিস্তানের পাশের রাষ্ট্র ইরানও যে একটু বেশিই খুশি হবে এটা রাজনীতি বিশ্লেষকরা অহরহই বলেন ও লেখেন। সবকিছু মিলিয়ে একটা বিষয় সহজেই অনুমেয়, বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান হাল-হকিকত ও গতিবিধি অনেকটাই চীন ও রাশিয়ার অনুকূলে।

লেখক : গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist